ড. কে, এম, খালেকুজ্জামান: মাষকলাই-এ প্রায় শতকরা ২০-২৩ ভাগ আমিষ থাকে। মাষকলাই-এর কয়েকটি জাত হল: বারি মাষ-১ (পান্থ), বারি মাষ-২ (শরৎ), বারি মাষ-২ (হেমন্ত), বিনা মাষ-১। একক ফসল হিসেবে মাষকলাই চাষ করলে ২-৩টি চাষ ও ৪-৫ বার মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। এ প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি থেকে প্রায় ৩-৪ মণ মাষকলাই উৎপাদন করা সম্ভব। মাষকলাই উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করা সম্ভব।
মাস কলাই চাষঃ আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতের ডাল ফসল চাষ করা হয়। মাস কলাই এ ডাল ফসলের মধ্যে অন্যতম। এর ইংরেজি নাম Black gram বা Urid bean এবং বৈজ্ঞানিক নাম Vigna mungo. এটি হচ্ছে একটি আমিষ জাতীয় খাদ্য ফসল। দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাস কলাই-এর চাষ বেশি হয়ে থাকে। দেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য এটি হচ্ছে একটি জনপ্রিয় ডাল। বর্তমানে আমাদের দেশের অন্যান্য এলাকাতেও মাস কলাই-এর চাষ করা হচ্ছে। অনেক অঞ্চলে এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতেও মাস কলাই চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। একজন বেকার নারী বা পুরুষ নিজের কর্মসংস্থান ব্যবস্থার জন্য মাস কলাই চাষ করে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
পুষ্টিগুনঃ মাস কলাই-এ প্রায় শতকরা ২০-২৩ ভাগ আমিষ থাকে।
বাজার সম্ভাবনাঃ
আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ মাংস থেকে তাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে মাস কলাই ডাল এসব মানুষের আমিষের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। সব শ্রেণীর মানুষই তাদের দেহের প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য মাস কলাইয়ের ডাল খায়। মাস কলাই উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করা সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। মাস কলাই বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
মাস কলাই উৎপাদন কৌশল ও চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু | মাটির প্রকৃতি |
এলাকাভেদে বপন সময়ের তারতম্য দেখা যায়। খরিপ-১ মৌসুমে মধ্য ফাল্গুন থেকে ৩০ ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মধ্য মার্চ) ও খরিপ-২ মৌসুমে ১লা ভাদ্র থেকে ১৫ ভাদ্র (আগস্টের ১৫-৩১) এসময়ে বীজ বপন করা যায়। দেশের মধ্যাঞ্চলে আশ্বিন মাসের শেষ পর্যন্ত সময়ে বীজ বোনা যায়। | সব ধরণের মাটিতে মাস কলাই চাষ করা যেতে পারে। তবে সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি মাসকলাই উৎপাদনের জন্য বেশি উপযোগী। |
জাত
বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট মাস কলাই-এর কয়েকটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
* বারি মাস-১ (পান্থ)
১. ১৯৯০ সালে বারি মাস-১ বা পান্থ জাতটি চাষের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
২. গাছের উচ্চতা ৩২-৩৬ সে.মি।
৩. বীজের রঙ কালচে বাদামী ও পাকা ফলের রঙ বাদামী।
৪. এ জাতটি দিন নিরপেক্ষ, তাই খরিপ-১, খরিপ-২ ও বিলম্ব রবি মৌসুমে চাষ করা সম্ভব।
৫. জীবনকাল ৭০-৭৫ দিন।
৬. প্রতিবিঘা জমিতে গড় ফলন প্রায় ২০০ কেজি।
৭. বংশগতভাবে জাতটি হলুদ ভাইরাস ও পাতার দাগ রোগ সহনশীল।
* বারি মাস-২ (শরৎ)
১. ১৯৯৬ সলে এই জাতটি চাষের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
২. গাছের উচ্চতা ৩৩-৩৫ সে.মি. ও স্থানীয় জাতের মতো লতানো হয় না।
৩. পত্র ফলকগুলি মাঝারি সরু।
৪. পাকা ফলের রঙ কালচে, ফল খাড়া ও ফলের গায়ে শয়া বা শুং আছে।
৫. বীজের আকার স্থানীয় জাতের চেয়ে বেশ বড় ও এক হাজার বীজের ওজন ৩২-৩৬ গ্রাম।
৬. আমিষের পরিমাণ ২১-২৪%।
৭. জীবনকাল ৬৫-৭০ দিন।
৮. প্রতিবিঘা জমিতে গড় ফলন প্রায় ২২০ কেজি।
৯. জাতটি দিন নিরপেক্ষ, তাই খরিপ-১, খরিপ-২ ও বিলম্ব রবি মৌসুমে চাষ করা যায়।
১০. বংশগতভাবে জাতটি হলুদ ভাইরাস ও পাতার দাগ রোগ সহনশীল।
*বারি মাস-২ (হেমন্ত)
১. ১৯৯৬ সলে এ জাতটি কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য অনুমোদন করা হয়।
২. গাছের উচ্চতা ৩৫-৩৮ সে.মি. ও স্থানীয় জাতের মতো লতানো হয় না।
৩. ফল পাকলে কালো হয় এবং ফলের গায়ে ঘন শয়া বা শুং আছে।
৪. বীজের রঙ কালচে এবং আকার স্থানীয় জাতের চেয়ে বড়।
৫. এক হাজার বীজের ওজন ৪০-৪৫ গ্রাম।
৬. জীবনকাল ৭০-৭৫ দিন।
৭. এক বিঘা জমিতে গড় ফলন প্রায় ২৪০ কেজি।
৮. জাতটি দিন নিরপেক্ষ, ফলে খরিপ-১, খরিপ-২ ও বিলম্ব রবি মৌসুমে চাষ করা হয়।
৯. এ জাত হলদে মোজাইক রোগ ও পাতার দাগ রোগ সহনশীল।
* বিনা মাস-১
১. ফলন ও অন্যান্য গুণাগুণ স্থানীয় জাতের চেয়ে ভালো; তাই সারা দেশে চাষাবাদের জন্য ১৯৯৪ সালে এ জাতটি অনুমোদন লাভ করে।
২. বিনা মাস-১ এর কান্ড শক্ত খাড়া।
৩. গাছের উচ্চতা ২০-২৫ সে.মি.।
৪. মাতৃজাত থেকে ফলন সর্বোচ্চ ৩১% বেশি।
৫. বীজের রঙ কালো।
৬. আমিষের পরিমাণ ২৫-২৬%।
৭. প্রতি বিঘা জমি থেকে গড় ফলন প্রায় ১৩০ কেজি।
৮. বীজ বপন থেকে কাটা পর্যন্ত এলাকাভেদে ৮০-৮৫ দিন সময় লাগে।
৯. এ জাত হলুদ মোজাইক ও পাতা পচা রোগ সহনশীল।
জমি তৈরি
১. একক ফসল হিসেবে মাস কলাই চাষ করলে ২-৩টি চাষ ও ৪-৫ বার মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। এতে বীজের অংকুরোদগমের হার বেড়ে যায় এবং ফসলের বৃদ্ধিও ভালো হয়।
২. দানা জাতীয় ফসলের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে এর চাষ করা হলে জমি দানা জাতীয় ফসলের জন্য তৈরি করলেই হবে।
৩. ফসলকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করে তুলতে হলে ৩-৪টি চাষ ও ভালোভাবে মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে।
বীজ বপন
১. বাংলাদেশে মাস কলাইয়ের চাষ একক, আন্তঃ, মিশ্র ও সাথী ফসল হিসেবে করা হয়ে থাকে।
২. দুইভাবে এর বীজ বপন করা যায়। ছিটিয়ে ও সারি করে।
৩. লাইন বা সারি করে মাস কলাই চাষ করলে বেশি ফলন পাওয়া যায়।
৪. সারিতে বীজ বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সে. মি. এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১০ সে. মি. রাখতে হবে।
৫. বীজ কিছুটা গভীরতায় বপন করলে অংকুরোদগম ভালো হবে এবং পাখি বীজ নষ্ট করতে পারবে না।
৬. বীজ ৩-৪ সে. মি. গভীরে বপন করতে হবে।
সার প্রয়োগঃ কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে মাস কলাই চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশে-পাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ ও নিষ্কাশন
১. মাস কলাই কিছুটা খরা সহ্য করতে পারে; তাই চাষের জন্য বেশি পানির প্রয়োজন হয় না।
২. বীজ বপনের সময় মাটিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে অংকুরোদগম নিশ্চিত করার জন্য বীজ বপনের আগে একটা হালকা সেচ দিতে হবে।
৩. বেশি বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমলে তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. অতিরিক্ত খরা ও জলাবদ্ধতা উভয়ই মাস কলাইয়ের জন্য ক্ষতিকর।
তথ্যসূত্র : আফজাল, মো. আলী; বকর, মো. আবু; রহমান, ড. মো. লুৎফর, মে ১৯৯৯, বাংলাদেশে মাস কলাইয়ের চাষ মসুর, মাস কলাই ও মুগ ডাল উৎপাদন বৃদ্ধির পাইলট প্রজেক্ট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০১।
কৃপ্র/ এম ইসলাম