কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লাখ টন কয়লা ও চুনাপাথর আনা হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদ ও শিবসা নদী এবং বিভিন্ন খাল দিয়ে এসব রামপালে পৌঁছাবে। কয়লা ও চুনাপাথর বহনকারী জাহাজগুলোর সমুদ্র থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ৫২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এই পথে ডলফিনের দুটি অভয়ারণ্য, সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগারসহ মহা বিপন্ন প্রজাতির বেশ কিছু প্রাণীর বিচরণ এলাকা রয়েছে। ফলে প্রাণিকুল নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। রামপাল প্রকল্পের কয়লা পরিবহনের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা রয়েছে। খবর প্রথম আলো অনলাইন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) সমীক্ষাটি চূড়ান্ত করেছে। রামপাল মৈত্রী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী কোম্পানির অর্থায়নে এ সমীক্ষা করা হয়।
মূলত প্রকল্পের কারণে কোন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা জানতে ও বুঝতেই এই সমীক্ষা করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ইআইএ সমীক্ষা এবং ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হয়। মৈত্রী কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপ দেওয়া হয়েছে। মতামত সংগ্রহে ইতিমধ্যে ঢাকা, মোংলা ও বাগেরহাটে এই প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা হয়েছে। আজ খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক ওয়াজি উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রামপালে কয়লা পরিবহনের ফলে পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যত ধরনের প্রভাব পড়বে, তা আমরা চিহ্নিত করেছি। এই ঝুঁকিগুলো কীভাবে কমানো যায়, তার পরামর্শ দিয়েছি। এসব মেনে চললে সম্ভাব্য ক্ষতি অনেক কমে আসবে।’
ইআইএর প্রতিবেদনে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাক-নির্মাণ পর্যায়, নির্মাণ পর্যায় ও নির্মাণ-পরবর্তী পরিচালনা এবং তদারকি পর্যায়ে ১২ ধরনের মোট ৮৩টি প্রভাব ও ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। ১২ ধরনের প্রভাবের মধ্যে ১১টি পরিবেশগত ঝুঁকি। একমাত্র ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব হিসেবে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়লা পরিবহনের সময় জাহাজ থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য সুন্দরবনে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে চিহ্নিত হওয়া ঝুঁকির মধ্যে কয়লা ও বাতাসের ঘর্ষণে আগুন ধরে যাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এমন মানের কয়লা আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে বাতাসের ঘর্ষণে আগুন ধরবে না। আমদানিকারক দেশ থেকে ওই নিশ্চয়তাপত্র নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া জাহাজের শব্দ, আলো, ধোঁয়ায় কম্পনের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়লা পরিবহনের এই সমীক্ষাটি নিয়ে আমরা দুটি জেলায় যে আলোচনাগুলো করেছি, তাতে আরও নিশ্চিত হয়েছি যে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি না করেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারব। আমরা এমন উন্নত জাহাজে করে কয়লা আনব, যাতে এত আস্তে শব্দ হবে যে বনের প্রাণীদের সমস্যা হবে না। জাহাজের আলো খুব সীমিত থাকবে, পানিতে কম্পনও কম হবে। প্রাণীদের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়লা পরিবহন-পথের পাশাপাশি রামপালে কয়লা এনে তা জাহাজ থেকে প্রকল্প এলাকায় স্থানান্তরের সময় কয়লার ব্যাপক ধুলা ও বিষাক্ত পদার্থ চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইআইএর প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায়নি। আর রামপাল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যেভাবে প্রযুক্তি দিয়ে দূষণ শতভাগ রোধ করবে বলছে, তা অবৈজ্ঞানিক। কারণ, পৃথিবীর এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যেখানে কেউ দাবি করতে পারে, শতভাগ দূষণ রোধ করা যাবে। বলা যায়, দূষণ কমিয়ে আনা যাবে। কিন্তু এই অল্প দূষণও সাধারণ এলাকার যতটা ক্ষতি করবে, সুন্দরবনের ক্ষতি করবে তার কয়েক গুণ বেশি।
বদরূল ইমাম আরও বলেন, গত দুই বছরে সুন্দরবনে পাঁচ-ছয়টি তেল-কয়লা ও সিমেন্টবাহী জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো ছিল ছোট জাহাজ, সেই ক্ষতি মোকাবিলায় তেমন কোনো সঠিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে রামপালে এসে সবকিছু শতভাগ শুদ্ধ হয়ে যাবে, এ আস্থা রাখা যায় না। রামপাল প্রকল্পে কয়লা পরিবহনের জন্য তিনটি পথের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে পশুর নদ দিয়ে মোংলায় কয়লা নিয়ে যেতে ১৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এই পথের ৮০ শতাংশই সুন্দরবনের মধ্যে পড়েছে। শিবসা চ্যানেল দিয়ে গেলে ১৫৩ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে এবং এই পথের ৭৫ শতাংশ সুন্দরবন। সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে বলেশ্বর নদ হয়ে ঘসিয়াখালী খাল দিয়ে গেলে পাড়ি দিতে হবে ১৯৬ কিলোমিটার পথ।
উজ্জ্বল কান্তি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পশুর নদ দিয়ে মোংলা হয়ে রামপালে কয়লা নেওয়ার কথা ভাবছি। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিত পুরোনো পথ।’ এই পথে ডলফিনের অভয়ারণ্য পড়েছে এবং বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী এই অভয়ারণ্যে জাহাজ চলাচল নিষেধ। এই তথ্য উল্লেখ করে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই পথ দিয়ে তো মোংলা বন্দরে নিয়মিত জাহাজ যাচ্ছে। আমাদের শুধু দিনে দু-একটি জাহাজ বেশি যাবে।’
ইআইএর প্রতিবেদনে কয়লা পরিবহনের ফলে বন্য প্রাণীদের শরীর ও আচরণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কার কথাও উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী বেঙ্গল টাইগার, দুই প্রজাতির ডলফিন, নোনা পানির কুমির, ভোঁদড়; পাখিদের মধ্যে মাসকট ফিন ফুট, স্পুন বিলড সেন্ডপাইপার, হোয়াইট রমপেড শকুন, স্লেনডার বিলড শকুন, হোয়াইট হেডেড ডাক ও গ্রেটারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। জাহাজের শব্দ প্রাণী ও পাখিদের বিরক্তির কারণ হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়লা পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত এলাকার দুই পাশে ৩ লাখ ২০ হাজার ৫০০ একর ভূমি রয়েছে। এর প্রায় ১২ শতাংশ কৃষিজমি ও চিংড়িঘের, ৩৬ শতাংশ বনভূমি ও ৪৮ শতাংশ এলাকায় জলাভূমি ও বসতি রয়েছে। জলাভূমিতে ৩২৬ জাতের মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়িজাতীয় প্রাণী, ৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৩ প্রজাতির সাপ ও ২২ প্রজাতির ঝিনুক রয়েছে।
জানতে চাইলে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল বিভাগের বন সংরক্ষক অসিত রঞ্জন পাল বলেন, সুন্দরবন বাংলাদেশের শুধু নয়, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অন্যতম বড় আধার। এই বনের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য এখানকার প্রধান সম্পদ। কাজেই সবার উচিত এমন কিছু না করা, যাতে এই সম্পদের ক্ষতি হয়।
কৃপ্র/ এম ইসলাম