কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ পদ্মার বুকে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে সেতুর কাঠামো। জাজিরায় পদ্মার বুকে সেতুর পিলারের ভিত্তি স্থাপনের কাজ চলছে পুরোদমে। এর ওপর হবে পিলার। আর আগামী বছরের শুরুতে পিলারের ওপর বসানো হবে স্টিলের কাঠামো। ভবিষ্যতে এর ওপর দিয়ে যানবাহন এবং ভেতর দিয়ে ট্রেন চলবে।
এ লক্ষ্যে পদ্মার দুই পাড়েই পাল্লা দিয়ে চলছে কাজ। প্রায় দেড় হাজার বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও শ্রমিকের কোলাহলে মুখর প্রকল্প এলাকা। ভবিষ্যতে তা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে বলে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। দুই শতাধিক ভারী ক্রেন ও হাইড্রোলিক হাতুড়ির শব্দ পদ্মাপাড়ের নীরবতা ভাঙছে প্রতিনিয়ত। সেতু বিভাগের হিসাবে, গত জুলাই পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৩৫ শতাংশ। যদিও ২০১৮ সালের শেষের দিকে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে সরকারের। খবর প্রথম আলো অনলাইনের।
গত ২৩ আগস্ট সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইতিমধ্যে চীন থেকে স্প্যান হিসেবে বসানোর জন্য টুকরো টুকরো স্টিলের কাঠামো মাওয়ায় এসে গেছে। চলছে জোড়া লাগানোর কাজ। নদীতে দুটি পিলার নির্মাণের কাজ শেষ হলেই এর ওপর বসানো হবে এই কাঠামো। শুধু প্রকল্প এলাকায় নয়, চীনেও স্টিলের কাঠামো নির্মাণে কাজ চলছে। আর বেলজিয়ামে তৈরি হচ্ছে সেতুর রেলসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, পিলারের ওপর স্টিলের অবকাঠামো বসানোর কাজ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শুরু হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পরিকল্পনা অনুসারেই এগোচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসেই পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে।
এখন মূল সেতুর কী কাজ হচ্ছে: সেতুর কাজের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলীরা বলছেন, মাওয়া চৌরাস্তা থেকে শুরু হয়ে জাজিরার মাঝিরঘাট এলাকায় এটি শেষ হবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর মাওয়া প্রান্তে যখন কাঠামো জোড়া দেওয়ার কাজ চলছে, তখন জাজিরা অংশে নদী ও ডাঙায় সমানে চলছে পিলার নির্মাণের প্রস্তুতি। ভাদ্রের প্রচণ্ড গরমে চীনা কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে হাসিমুখে কাজ করে চলেছেন বাঙালি শ্রমিকেরা। ঘেমেনেয়ে একাকার হলেও চেষ্টা করে চলেছেন দ্রুত সেতুর কাজ শেষ করতে।
পাড়ের কাছে নদীর ভেতরে রয়েছে বড় বার্জ, আর সেখানে বসানো হয়েছে উত্তুঙ্গ ক্রেন। আছে জার্মানি থেকে আনা হাইড্রোলিক হাতুড়ি। সব আয়োজনই হলো নদীতে পিলার তৈরির জন্য, যা নদীর ১২০ মিটার বা তারও বেশি গভীরে বসানো হচ্ছে। নদীতে ৪১টি পিলার হবে, যার দুটির দূরত্ব হবে ১৫০ মিটার। এখানেই বসবে স্টিলের কাঠামো।
মাওয়ার কুমারভোগে পদ্মার তীর ঘেঁষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি চত্বর তৈরি করেছে, যা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রায় দেড় কিলোমিটার। সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় শেড। এর মধ্যে বসানো হয়েছে উঁচু উঁচু ক্রেন। এগুলো দিয়ে পাশের জেটি থেকে টেনে স্টিলের কাঠামো শেডে রাখা হচ্ছে। একদল শ্রমিক সেখানে কাজে ব্যস্ত। তাঁদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন চীনের প্রকৌশলীরা। কেউ ওয়েল্ডিংয়ে ব্যস্ত, কেউ করছেন নাট-বল্টু পরিষ্কারের কাজ। ২০-৩০ মিটার লম্বা এসব স্টিলের কাঠামো জোড়া দিয়ে রং করা হবে। একপর্যায়ে এটি লম্বায় ১৫০ মিটারের একটি স্প্যানে পরিণত হবে।
ওই শেডে কাজ করছেন স্থানীয় ফারুক ও দোহারের সিফাত হোসেন। তাঁরা বলেন, সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করেন তাঁরা। মাঝখানে দেড় ঘণ্টার বিরতি। বেতন পান ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। সবাই অদক্ষ শ্রমিক। ছুটিছাটা নেই বললেই চলে।
যন্ত্রপাতি আর মালামালের এলাহি কাণ্ড: প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ পর্যন্ত মূল সেতুর মালামাল ওঠা-নামা এবং পাইলিংয়ের কাজের জন্য দুই শতাধিক ক্রেন এসেছে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায়। এসব ক্রেনের মধ্যে এক হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেনও রয়েছে। পাইল বসানো ও অন্যান্য কাজের জন্য রয়েছে তিনটি হাতুড়ি। সূত্র জানায়, আগামী মাসে আরও দুটি শক্তিশালী ক্রেন আসবে। এর একটি চার হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন। এই ক্রেন দিয়ে ১৫০ মিটার লম্বা স্টিলের স্প্যান বহন করে সেতুর পিলারে স্থাপন করা হবে। এই স্প্যানের ওজন প্রায় তিন হাজার টন।
অন্য অঙ্গের কাজ: পদ্মা সেতু অর্থাৎ যার ওপর দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলবে, তা প্রকল্পের মূল অঙ্গ। এর সহযোগী আরও কতগুলো অঙ্গ রয়েছে, যা না হলে সেতু কাজে লাগবে না বা নির্মাণ করা যাবে না। এই অঙ্গগুলোর মধ্যে রয়েছে নদীশাসন, দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক ও টোল প্লাজা নির্মাণ এবং প্রকল্প সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ।
প্রকল্পের অগ্রগতি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ২৮ শতাংশ। এ পর্যন্ত ঠিকাদারকে টাকা দেওয়া হয়েছে ৩৫ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ এগিয়েছে ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬ ও জাজিরায় ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদীপাড় শাসন করা হবে।
মাওয়ায় দেড় কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে সাড়ে ১০ কিলোমিটার মিলে মোট ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও টোল প্লাজা নির্মাণের কাজ করছে বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। মাওয়ার কাজ শেষ করার কথা ছিল গত জুনে। কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ফাইন টিউনিং বাদ দিলে কাজ প্রায় শেষ। তবে জাজিরা প্রান্তের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্ভব হবে না। সূত্র জানায়, জাজিরার সংযোগ সড়ক এলাকায় কিছু নরম মাটি পড়েছে। এর ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করলে ধসে পড়ার আশঙ্কা ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে মাটি খুঁড়ে এর মধ্যে বালু দিয়ে উন্নয়ন করতে হয়েছে। এ জন্য সময় ও ব্যয় কিছুটা বাড়ছে।
পদ্মা সেতুর ব্যয় ও ঠিকাদার: সর্বশেষ সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। গত জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। পুরোটাই ব্যয় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। যদিও শুরুতে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা ছিল।
দুই পাড়ে রেল নির্মাণ করবে চীন: পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ স্থাপনের জন্য চীনের চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী এর মধ্যে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা দেবে চীন এবং ১০ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বাংলাদেশ দেবে। প্রকল্পটি চার ধাপে ২০২২ সালের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭৮ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকার গেন্ডারিয়া স্টেশন থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে মাওয়া পর্যন্ত যাবে রেললাইন। এরপর জাজিরা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ হবে। গেন্ডারিয়া থেকে মাওয়া অংশে অনেক নদী থাকার কারণে বেশির ভাগ অংশ হবে উড়ালপথে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু চালুর দিন থেকে রেল চালু করা কঠিন। এখন মাওয়া থেকে ভাঙা পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের অগ্রাধিকার ঠিক করা হয়েছে। বাকি অংশ পরে করা হবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম