কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদঃ সম্প্রতি টাঙ্গাইলে প্রচুর মৌমাছি অজ্ঞাত কারণে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান এমনকি বিভিন্ন দেশেও মৌমাছিসহ বিভিন্ন সংকেত প্রদানকারী পোকামাকড় ও প্রাণী কমে যাচ্ছে। ফলজ, বনজ, কৃষি ফসল, হাঁস-মুরগির ডিম, গাভীর দুধ উৎপাদনসহ বিভিন্ন রকম কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিন কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর অদৃশ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় পরিবেশের উপরও প্রভাব পড়ছে। বিজ্ঞানীরাও গবেষণা করছেন। অজ্ঞাত কারণকে সবাই মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের প্রভাবকেই দায়ী করছে।
মোবাইল ফোনের টাওয়ারের গবেষণার কিছু তথ্য এখানে উল্লেখ করা হলো। মোবাইল ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশনের ওপর সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ৯২৬টি গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে ৬০১টি গবেষণায় পশু, পাখি, পোকামাকড়, অণুজীব এবং মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে। মোবাইল ফোন টাওয়ারের এক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০০ মেগাহার্টজ মাইক্রোওয়েভ ছড়ায়। মোবাইল ফোন টাওয়ার থেকে নির্গত ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন (ইএমআর) ঘটিত ইলেক্ট্রো স্মোগ খুবই ভয়ানক। তা পশু-পাখি, পোকামাকড়, উদ্ভিদ ও মানুষের জৈবিক সিস্টেমকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মানুষের ওপর প্রভাব : ইএমআর মানুষেরও ক্ষতি করছে। যেমন_ ব্রেন ক্যান্সার, কানের শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস, বুকের কাছে মোবাইল ফোন রাখলে হৃদপি-, যকৃত ও ফুসফুসের ক্ষতি, প্যান্টের পকেটে মোবাইল ফোন রাখলে পুরুষ প্রজননতন্ত্রের সমস্যা হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ মোবাইল ফোনের সেটের সঙ্গে টাওয়ারের যোগাযোগ হয়ে মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের মাধ্যমে। এই রেডিয়েশন বা ইএমআর মানবদেহের ভিতরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে ইয়ারফোন যারা ব্যবহার করে তাদের ক্ষতি হয় আরো বেশি। বাংলাদেশে যত্রতত্র মোবাইল ফোন টাওয়ারের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিটা খুব ধীরগতি হয় বলে সঙ্গে সঙ্গে প্রভাব পড়ে না। প্রভাব পড়ে দীর্ঘমেয়াদি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রাণিকুল ও উদ্ভিদকুল রক্ষায় সুপারিশ করেছে, বর্তমানে অবস্থিত টাওয়ারের এক কিলোমিটারের মধ্যে নতুন কোনো টাওয়ার নির্মাণ করা যাবে না। প্রতিটি টাওয়ার ৮০ ফুট উচ্চতায় কমপক্ষে ১৯৯ ফুট উঁচু হতে হবে।
মৌমাছির ওপর প্রভাব : মৌমাছিসহ গাছের ফুলে পরাগায়নে সাহায্যকারী পোকামাকড়ের ওপর প্রভাব বেশি পড়ছে। এসব পোকামাকড় বিলুপ্ত হলে গাছে পরাগায়ন বন্ধ হয়ে উদ্ভিদ বিলুপ্ত হবে খাদ্য উৎপাদন বন্ধ হবে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, মৌমাছি ধ্বংস হওয়ার চার বছরের মধ্যেই মানুষও নিশ্চিহ্ন হবে। বৈশ্বিক ফসল উৎপাদনে পরাগায়নকারী মৌমাছি ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান কাজ করে। পৃথিবীতে ৬০ শতাংশ উদ্ভিদের পরাগায়ন হয় প্রাণী পরাগায়নের মাধ্যমে।
মৌমাছি প্রায় ১০০টি ফসলের পরাগায়ন ঘটায়। মৌমাছির পরাগায়নে শতকরা ৩০-৪০% ফলন বাড়ে। আমেরিকার এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে মৌমাছি কমে যাচ্ছে। ইএমআর বৃদ্ধির কারণেই কমে যাচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মৌমাছিসহ যেসব পোকামাকড় ও প্রাণী সংকেত প্রদানের মাধ্যমে চলাচল করে সেসব পোকামাকড় ও প্রাণী ইএমআর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ ইএমআরের সংকেত ও পোকামাকড়ের সংকেতের মধ্যে আন্তঃকোষীয় যোগাযোগকে ব্যাহত করে।
এ ছাড়া উচ্চমাত্রার তড়িৎ চুম্বক ক্ষেত্রসম্পন্ন মোবাইল ফোন জীবিত প্রাণীর মস্তিষ্কের কিছু অংশে পরিবর্তিত রূপ দিতে পারে। যা মৌমাছিদের মৌচাকে ফিরে আসার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের রিসার্চ ইন্সটিটিউট ফর ন্যাচার অ্যান্ড ফরেস্টের বিজ্ঞানীরা সমগ্র ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মৌমাছি কলোনি ধ্বংসের কারণ হিসেবে ইএমআরকে চিহ্নিত করেন। ভারতে সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে কেরাল রাজ্যে ইএমআরের প্রভাবে বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি থেকে মধু উৎপাদন মারাত্মক কমে গেছে। ভারতের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মৌচাকে প্রতিদিন ২-১৫ মিনিট মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন দেন।
তিন মাস পরে দেখেন মৌচাকে মধু উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে, ডিম উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে এবং মৌচাক ছোট হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের একদল গবেষক প্রমাণ করেন ইএমআর শুধু মৌমাছিকে বিভ্রান্তই করে না মেরেও ফেলে। ইংল্যান্ডে বিগত ২০ বছরে মৌমাছির সংখ্যা শতকরা ৫৪ ভাগ কমেছে। যা পুরো ইউরোপের শতকরা ২০ ভাগ। স্পেনে শতকরা ৮০ ভাগ মৌচাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পিঁপড়া ও পাখির ওপর প্রভাব : পিঁপড়ার ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইএমআরে উন্মুক্ত পিঁপড়া ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং স্মৃতিশক্তি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হারিয়ে ফেলে। আলফোসনো বালমোরি প্রমাণ করেন, ইএমআরের প্রভাবে চড়ই, ঘুঘু, সারস, দোয়েল এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বাসা এবং স্থান পরিত্যাগ, পাখা কমে যাওয়া এবং গমন ক্ষমতা কমে যায়। রাশিয়ায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিম ফুটানোর সময়ে জিএসএম ফোনের কাছে উন্মুক্ত শতকরা ৭৫ ভাগ মুরগির ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায় এবং মোবাইল ফোন টাওয়ারের পাশের পাখির বাসা থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে পাখি বাসা ত্যাগ করে এবং ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না। প্যারাগুপোলাস এবং মার্গারিটিস বিজ্ঞানীদ্বয় প্রমাণ করেন, ডিজিটাল জিএসএম ফোনের কাছে উন্মুক্ত ফলের মাছি পোকার প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত প্রজননের ক্ষমতা কমে যায়। পুরুষ ও স্ত্রী পোকাকে প্রতিদিন ৬ মিনিট করে রেডিয়েশনে উন্মুক্ত রাখলে ৪-৫ দিনেই ৫০ ভাগ প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়।
অন্যান্য প্রাণীর ওপর প্রভাব : ব্যাঙের ওপর ইএমআরের প্রভাব পড়ে বলে গবেষণায় পাওয়া যায়। ইএমআরের প্রভাবে ব্যাঙাচির চলনে অক্ষমতা, বৃদ্ধি ব্যাহত ও মৃত্যুর হার বেশি হয়। যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে ইএমআরের প্রভাবে মাছ ও বাদুর মারা যায়। দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায় ও অকালে গর্ভপাত হয়। মোবাইল ফোন টাওয়ারের পাশে অবস্থানকারী শতকরা ৩২ ভাগ বাছুরের চোখে ছানি পড়ে। মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড় ও অণুজীবের ওপরও ইএমআরের প্রভাব পড়ে। ইএমআর তাপমাত্রা বাড়ায় ফলে এগুলো মারা যায়। দুই. রেডিয়েশনে উন্মুক্ত ৭০০ মেগাহার্টজ এবং ১৮০০ মেগাহার্টজ পূর্ণ বয়স্ক ফলের মাছিতে ৬ দিন প্রতিদিন কিছু সময় থাকলে তাদের ডিএনএ ভেঙে যায় এবং ডিম প্রকোস্ট নষ্ট হয়। এতে প্রজনন ক্ষমতা কমে বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
গাছপালার ওপর প্রভাব : বনজ বৃক্ষ, ফলদ বৃক্ষ, ফসলের গাছ ইত্যাদি উদ্ভিদ জগতের ওপর ইএমআর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে ইএমআর বীজের বৃদ্ধি, অঙ্কুরোদ্গম ব্যাহত, মূলের বৃদ্ধি ব্যাহতসহ সঠিক উৎপাদনকে ব্যাহত করে। মোবাইল ফোন টাওয়ারের আশপাশের জমিতে ফলন কম হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নারিকেলগাছসহ উঁচু গাছের কাছে টাওয়ার থাকলে সেখানেও উৎপাদন ব্যাহত হয়। জার্মানের বনাঞ্চল কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ইএমআরকে দায়ী করা হয়েছে। নিম্নমাত্রার রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রেডিয়েশনও গাছের ক্ষতি করে।
বিকল্প চিন্তা : টাওয়ার ছাড়াও সফটওয়্যারের মাধ্যমে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যায়। এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিনডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. পলগার্ডনার স্টিফেন তৈরি করেছেন ‘ডিস্ট্রিবিউটেড নাম্বারিং আর্কিটেকচার’ বা ডিএনএ নামের একটি সফটওয়্যার। যতক্ষণ কথা বলা হবে ততক্ষণ এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক তৈরি হবে দুটো মোবাইল সেটের মধ্যে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যায়। এমনিতেই আমাদের দেশে বিভিন্ন পরিবেশ দূষণের কারণে কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। এর পরে মোবাইল ফোন টাওয়ারের রেডিয়েশন নতুন করে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য চিন্তা বাড়িয়ে দিল। এর জন্য অবশ্যই বিকল্প ব্যবস্থা বের করে দেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বাঁচাতে হবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম