কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি সবচেয়ে দূষিত। আর রাজধানীর বাবুবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্ষতিকর ভারী ধাতু সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম ঝিনুক বা আর্টিফিশিয়াল মাসেল ব্যবহার করে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, খুলনার ভৈরব ও চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলের পানিতে ভারী ধাতুর (হেভি মেটাল) উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। এসব ধাতু জীববৈচিত্র্য ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খবর প্রথম আলো অনলাইনের।
বৈশ্বিক গবেষণার অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ ও হংকংয়ের বিজ্ঞানীরা ২০১৩ ও ২০১৪ সালে নদী, মোহনা ও সমুদ্র উপকূলের পানিদূষণ ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষক দলের নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমটিআই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসের পরিবেশ গবেষক ড. গোলাম কিবরিয়া। এ বিষয়ে তাঁদের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কেমোস্ফেয়ার জার্নালে ছাপা হয়েছে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা প্রকাশনা সংস্থা এলসিভিয়ারের সাময়িকী কেমোস্ফেয়ার নেদারল্যান্ডস থেকে বের হয়।
গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘নতুন এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে এর আগে ব্যবহার করা হয়নি। বৈশ্বিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমি বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি প্রথম প্রয়োগ করেছি।’ তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার পানিদূষণের কথা সবারই জানা। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য ও নতুন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ও মৎস্য ইনস্টিটিউট এই গবেষণায় যুক্ত ছিল।
কৃত্রিম ঝিনুকের মাধ্যমে একটানা ২৮ দিন নদী বা সমুদ্রের পানি পরীক্ষা করা যায়। এই প্রযুক্তি নদী বা সমুদ্রের পানি জীবন্ত ঝিনুকের মতো পরিশ্রুত (ফিল্টার) করতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাসাগর, সমুদ্র উপকূল, নদী, জলাভূমি, নর্দমা, যেখানে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই সেখানকার পানির দূষণ পর্যবেক্ষণ করা যায়। এগুলো বিশেষভাবে তৈরি ৬০ মিলিমিটার দৈর্ঘ্য ও ২৫ মিলিমিটার বেড়ের একধরনের টিউব।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক সুলতান আহমেদ এই গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা দেশের বিভিন্ন নদীর পানি পরীক্ষা করে বুড়িগঙ্গার পানিকেই অন্যতম দূষিত হিসেবে দেখতে পেয়েছি। তবে এই গবেষণায় নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণের পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি নদীর পানিতে ভারী ধাতুর অস্তিত্ব নিয়ে অন্য যেসব গবেষণা হয়েছে, তার ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করা উচিত।’
বিজ্ঞানীরা চট্টগ্রাম, ঢাকা ও খুলনাকে বেছে নিয়েছিলেন সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে। চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, শিল্প এলাকা এবং দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। ১৪৪টির মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিদিন কর্ণফুলী নদীতে নানা ধরনের বর্জ্য ফেলে। আর রাজধানী ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গায় টেক্সটাইল, ওষুধ, সিমেন্ট, রাবার, পাল্প, সার, চামড়া, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, কাচ, তেল কারখানার বর্জ্য পড়ে। এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজার টন কঠিন বর্জ্য এবং ২২ হাজার টন ট্যানারির বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় মেশে। খুলনা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদে সিমেন্ট কারখানা, পাটকল, মাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, জাহাজ তৈরির কারখানা, তেলবাহী জাহাজের বর্জ্য পড়ে।
এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল কৃত্রিম ঝিনুক ব্যবহার করে বাংলাদেশের নদী, মোহনা ও উপকূলে ১১ ধরনের ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরিমাপ করা। এ ছাড়া কোন এলাকায় দূষণ সবচেয়ে বেশি, সেই ‘হট স্পট’ চিহ্নিত করা, পাশাপাশি প্রতিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যে দূষণের প্রভাব মূল্যায়ন করা।
বিজ্ঞানীরা চট্টগ্রামের জাহাজঘাট, উত্তর পতেঙ্গা, উত্তর কাট্টলী ও বাঁশবাড়িয়া এলাকা বেছে নেন। আর ঢাকার মধ্যে ছিল বাবুবাজার ব্রিজ, কামরাঙ্গীরচর ও আগানগর। গবেষণার স্থান হিসেবে খুলনার মীরেরডাঙ্গা, হার্ডবোর্ড মিল খেয়াঘাট ও মোংলা পোর্টের জেটি এলাকা নেওয়া হয়। এই ১২টি স্থানে ২০১৪ সালের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পানি পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার জন্য প্রতিটি স্থানে একটি প্লাস্টিকের ঝুড়িতে করে তিনটি করে কৃত্রিম ঝিনুক রাখা হতো। চার সপ্তাহ পরপর তা পাল্টানো হতো।
কৃত্রিম ঝিনুকে জমা হওয়া রাসায়নিক ও ধাতু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব অঞ্চলের পানিতে ক্যাডমিয়াম, কপার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, লেড, ইউরেনিয়াম, জিঙ্ক, মার্কারি, ক্রোমিয়াম ও কোবাল্ট—এই ১১টি ধাতব পদার্থ আছে। প্রথম আটটি ধাতু সব জায়গায় পাওয়া গেছে।
পানিতে ভারী ধাতু সর্বোচ্চ পরিমাণে আছে এমন এলাকাকে ‘হট স্পট’ বলছেন বিজ্ঞানীরা। এ রকম হট স্পট তাঁরা পেয়েছেন সাতটি। এর মধ্যে পাঁচটি হট স্পট বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গায় একই স্থানে একাধিক ধাতব পদার্থ সর্বোচ্চ পরিমাণে পাওয়া গেছে। তার ভিত্তিতেই তাঁরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী। আর এর মধ্যে বাবুবাজার এলাকার পানিতে একই সঙ্গে চারটি (কপার, নিকেল, লেড ও আয়রন) ভারী ধাতু শনাক্ত হয়েছে। গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘১২টি স্থানের মধ্যে বাবুবাজার-সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা সবচেয়ে দূষিত।’
স্বাস্থ্যে প্রভাব: ক্যাডমিয়াম ও সিসা ঝিনুক, শামুক, বাগদা, গলদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছে জমা হতে পারে। এগুলো খাওয়ার মাধ্যমে ক্যাডমিয়াম ও সিসা মানুষের শরীরে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। আবার দূষিত পানি সেচে ব্যবহার করলে পানিতে থাকা কিছু ধাতব পদার্থ শাকসবজিতে প্রবেশ করে। ওই শাকসবজি থেকে ধাতব পদার্থ মানুষের শরীরে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। এসব ধাতব পদার্থ ক্যানসারের কারণ হতে পারে। আবার কোনো কোনোটি স্নায়ুতন্ত্র বা কিডনির ক্ষতি করে।
তবে গবেষণায় দেখানো হয়নি কোন ভারী ধাতুর পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আছে। ড. সুলতান আহমেদ বলেন, ‘গবেষণার একটি পর্যায় শেষ হয়েছে, যেখানে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে। এরপরে হয়তো ভারী ধাতুর পরিমাণ এবং কোন ধাতু মানব শরীরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কতটা বেশি, তা জানা যাবে।’
কৃপ্র / এম ইসলাম