‘বিলীন হলো একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়’
এম.এ ওয়াদুদ মিয়া, শরীয়তপুর: আবারও শুরু হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরার কুন্ডেরচরে পদ্মা নদীর রাক্ষুসী তান্ডব। দেড় হাজারেও বেশী মানুষের বসত বাড়ি কেড়ে নেয়ার পর, সর্বনাশা পদ্মা এবার কেড়ে নিলো এই চরাঞ্চলের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পাকা ভবনটি। ফলে জে.এস.সি, এস.এস.সি এবং বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহনকারী আট শতাধীক শিক্ষার্থী পড়েছে বিপাকে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। অবশ্য প্রশাসন বলেছে বিকল্প ব্যবস্থায় যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া হবে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে সুর্যাস্তের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত শত শত ছাত্র-ছাত্রীদের আনন্দ উল্লাসে মুখরিত ছিল কুন্ডেরচর আলহাজ্ব মোঃ ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়টি। বুধবার সুর্যাদয়ের পূর্বেই ম্লান হয়ে গেছে সেই সব আনন্দ উল্লাস। গভীর রাতে রাক্ষুসী পদ্মা কেড়ে নিয়েছে বিদ্যালয়ের নব মির্মিত একাডেমিক ভবনটি। বুধবার সকালে শত শত ছাত্র-ছাত্রীদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে কুন্ডেরচর পদ্মা পাড়ের আকাশ বাতাস। ৮ শতাধিক শিক্ষার্থীর প্রিয় বিদ্যালয়টি প্রকৃতির খাম খেয়ালীতে এভাবে হারিয়ে যাবে এটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, জুলাই মাসের ২৫ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন। ইতিমধ্যে কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ৬,৭,৮ এবং ৯ নং ওয়ার্ডের হাজী মকবুল খালাসীর কান্দি, হাজী মোহাম্মদ খালাসীর কান্দি, চোকদার কান্দি, মোমিন খালাসীর কান্দি, আহমদ মোল্যার কান্দিসহ ৫ টি গ্রাম সম্পুর্নভাবে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইয়াকুব মাদবর কান্দি, ইউসুফ বেপারীর কান্দি ও রিয়াজ উদ্দিন মাদবরের কান্দি গ্রামের আংশিক বিলীন হয়েছে। শুধু তাই নয়, পার্শবর্তী নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের গফুর বেপারীর কান্দি গ্রামের একটি বিশাল অংশ ইতিমধ্যে ভাঙ্গনের কবলে পরে শতাধিক বসত বাড়ি ও স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
পদ্মা পাড়ের মানুষের সাথে আলাপ কালে জানা যায়, গত ৫০ বছরের মধ্যে এ বছরই সবচেয়ে বেশী ভাঙ্গনের কবলে পরেছে তারা। প্রতি ঘন্টায় পদ্মার গর্ভে বিলীন হচ্ছে শত শত ঘর বাড়ি, গাছ পালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। জুলাই মাসের ২৫ তারিখের পর থেকে অন্তত ১ হাজার ৪ শতটি পরিবার তাদের সকল সহায় সম্পত্তি পদ্মা বক্ষে হাড়িয়েছেন। পাশাপাশি বিলীন হয়েছে ৯ টি গ্রামের ৫ টি পাকা জামে মসজিদ, দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি বড় বাজার, ৯ কিলো মিটার পাকা সড়ক, বিদ্যুতের লাইনসহ শত শত হেক্টর ফসলী জমি। গত দুই মাস ধরে থেমে থেমে চলেছে এই নদী ভাঙ্গন। সাত দিন বিরতির পর মঙ্গলবার গভীর রাতে বিলীন হয়েছে কুন্ডেরচর আলহাজ্ব মোঃ ইসমাইল মেমোরিয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন ভবনটি। যে ভবনটি মাত্র ৬ মাস পূর্বে ৬১ লক্ষ টাকা ব্যায়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, নতুন করে আবার ভাঙ্গন ঝুঁকিতে পড়েছে রিয়াজ উদ্দিন মাদবর কান্দি গ্রামসহ কয়েকটি পাকা স্থাপনা।
স্কুল ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে পরীক্ষা সহ সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে চরম বিপদে পড়েছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। তারা বিকল্প ব্যবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম এবং পরীক্ষা চালিয়ে নিতে দাবী জানিয়েছে সরকারের প্রতি।
কুন্ডেরচর আলহাজ্ব ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার, রুবিনা আক্তার, পনির কুমার বাড়ৈ এবং কাওসার হোসাইন বলেন, আমরা মঙ্গলবারও ক্লাস করেছি নতুন ভবনে। সারা দিন কাটিয়েছি স্কুল চত্বরে। আজ আমাদের স্কুলটি এভাবে ভেঙ্গে যাওয়ায় আমরা অনেক সমস্যায় পড়েছি। আজ থেকে আমাদের মডেল টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ক’দিন পরেই জে.এস.সি এবং এস.এস.সি’র নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হবে। এর পর বার্ষিক পরীক্ষা। সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস রয়েছে। স্কুলের ভবন না থাকলে আমরা ক্লাস করবো কি ভাবে ? আর ক্লাস করতে না পারলে পরীক্ষাইবা দিব কি ভাবে ? আমরা জরুরী ভিত্তিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
নদী ভাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত সমিরুদ্দিন মাদবর, ফিরোজা বেগম ও মতিউর রহমান খলিফা বলেন, সর্বনাশা পদ্মা নদী আমাদের বসত বাড়ি, জমি জমা সবইতো নিয়ে গেছে। এর আগে দুইটি প্রাইমারী স্কুল বিলীন হয়েছে। এখন এলাকার একমাত্র হাই স্কুলটিও চলে গেল। দুই বেলা খাই না খাই, বাচ্চাদের পড়া লেখা যে করাবো সেই নিশ্চয়তা টুকুও আমরা হারিয়ে ফেললাম। সরকার যেন অতি শীঘ্র স্কুল নির্মানের ব্যবস্থা করেন, এটাই আমাদের একমাত্র দাবী।
কলমীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহানারা বেগম বলেন, গত ২৭ আগষ্ট আমাদের স্কুলটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত আবুল হাশেম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচ তলায় চার শতাধিক শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে পাঠদান কার্যক্রম কোন রকমে চালিয়ে আসছিলাম। এখন সেই স্কুলটিও ভাঙ্গনের ঝুকিতে রয়েছে। স্কুল থেকে নদীর দুরত্ব মাত্র ১০ ফিট। যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। এই স্কুলটি বিলীন হলে দুইটি বিদ্যালয়ের এতোগুলো শিক্ষার্থী নিয়ে আমরা কোথায় গিয়ে দাড়াবো ভেবে পাচ্ছিনা।
কুন্ডেরচর আলহাজ্ব ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার দত্ত বলেন, গত ১৭ ফেব্রুয়ারী আমাদের স্কুলের নতুন ভবনটি হস্তান্তর করা হয়। ৬১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মান করা হয়েছিল। মাত্র ৫ মাস এই ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করতে পেড়েছি। মঙ্গলবার গভীর রাতে নতুন এই পাকা ভবন পদ্মা নদীতে বিলীন হয়। এখন প্রায় ৮ শত শিক্ষার্থী নিয়ে আমরা চরম বিপাকে পড়েছি। এলাকায় সাহায্য করার মত কেউ নেই। যারা সাহায্য করবে তাদেরও সব কিছু শেষ হয়ে গেছে নদী ভাঙ্গায়। এখন জরুরী ভিত্তিতে সরকার যদি কোন ব্যবস্থা না নেয় তাহলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মরা ছাড়া কোন পথ থাকবে না।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান এর সাথে আলাপ কালে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম যাতে প্রকার ব্যাহত না হয় সে জন্য, পার্শবর্তী স্কলে শিক্ষার্থীদেরকে শিফটিং পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম ও পরীক্ষা চালিয়ে নিতে ইউ.এন.ও এবং শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
কৃ প্র / এম ইসলাম