কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ মেহেরপুর, ‘গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ হচ্ছে’ বাংলার প্রাচুর্যের নির্মল কাব্যিক অভিব্যক্তি। বাংলার এ আদি ও অকৃত্রিম ঐশ্বর্য্য আকর্ষণ করেছে দেশ-বিদেশের মানুষকে। গ্রামবাংলার সেই । অথচ এক সময় ব্যক্তি বিশেষের সমাজে প্রভাব ও নেতৃত্ব নির্ভর করতো এ ধানের গোলার ওপর হিসেব কষেই। কন্যাপক্ষ কন্যাকে পাত্রস্থ করতেও বরপক্ষের বাড়ির ধানের গোলার খবর নিতো। যা এখন শুধুই কল্পকাহিনী।
গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে গোল আকৃতির তৈরিকৃত ধানের গোলা বসানো হতো উঁচুতে। গোলার মাথায় থাকতো টিনের তৈরি মিসরের পিরামিড আকৃতির মতো টাওয়ার। যা দেখা যেত অনেক দূর থেকে গোলার ধান বর্ষার পানি এবং ইঁদুর স্পর্শ করতে পারতো না। মই বেয়ে গোলায় উঠে তাদের ফসল রাখতে হতো।
এ সুদৃশ্য গোলা ছিল সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারের ঐতিহ্য। সে সময় ভাদ্র মাসে কাদা-পানিতে ধান শুকাতে না পেরে কৃষকরা ভেজা আউশ ধান রেখে দিত গোলাভর্তি করে।
গোলায় শুকানো ভেজা ধানের চাল হতো খুব শক্ত। যা একবেলা খেলে সারাদিন আর খিদে লাগত না। আউশ ধানের খড় খেয়ে মোটাতাজা হতো গবাদি পশু। মানুষও থাকত রোগমুক্ত ও হতো পরিশ্রমী।
বর্তমানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও অত্যাধুনিক কলের লাঙ্গল যেন সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। পাল্টে দিয়েছে সেই চিরাচরিত গ্রাম-বাংলার রূপ। ধান আবাদের উপকরণ কিনতে কৃষকের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। গোলায় তোলার মতো ধান আর তাদের থাকছে না। কৃষকের গোলার ধান এখন ঠাঁই পায় গুদাম ঘরে। গোলা ঘর এখন বিস্মৃত ইতিহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে
গোলাও স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্তি হতে যাচ্ছে। তবে কোন কোন অঞ্চলের মানুষের কাছে গোলার চাহিদা এখনও রয়ে গেছে।
মেহেরপুরের পিরোজপুর গ্রামে ভাষা সৈনিক নজির বিশ্বাসের বাড়িতে দেখা গেল দুটি ধানের গোলা। নজির বিশ্বাস জানান, অল্প জায়গায় অনেক ধান রাখা যায়। ধান শুকিয়ে রেখে দিলে অনেকদিন ধান ভাল থাকে। তিনি আরও জানান, একটা সময় ছিল যখন প্রতিটি বড় গৃহস্থের বাড়িতে ছিল গোলা। কার্তিক মাস এলেই দেশে খাদ্য সংকট দেখা যেত। মাঠে-ঘাটে থাকতো না কোন কাজ। তখন শ্রমজীবী ও প্রান্তিক কৃষকরা গ্রামের গৃহস্থের দ্বারস্থ হয়ে ধান দাদন নিত। ধান উঠলে প্রান্তিক কৃষক ও শ্রমজীবীরা সে ধান ফিরিয়ে দিত ধান। এসবএকদিন শুধুই অতীত দিনের স্মৃতি হয়েই থাকবে।
‘মেহেরপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থের লেখক প্রবীন সাংবাদিক তোজাম্মেল আযম গোলা প্রসঙ্গে বলেন, গোলা একসময় সামর্থ্যরে প্রতীক ছিলো। বিয়ে সাদীর সময় বর-কনে উভয় পক্ষ খবর নিতো বাড়িতে গোলা আছে কিনা। ছেলে শ্বশুর বাড়িতে কতটা সমাদর পাবে এবং মেয়ে স্বামীর বাড়িতে কতটুকু সুখে থাকবে তারও হিসেব-নিকেষ হতো করা যেতো গোলার মাধ্যমে। সেই গোলা এখন অতীত ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। তারপরও গ্রাম-বাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক গোলা এখনও অনেক গ্রামে,বিশেষ করে মেহেরপুরে রয়ে গেছে। তবে সেটা বেশিদিনের জন্য নয় বলে মনে হয়।
নয় বলে মনে হয়।
সুত্রঃ বাসস / রিপোর্টঃ দিলরুবা খাতুন/ কৃপ্র/ এম ইসলাম