কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সবাইকে হৈমন্তীয় শুভেচ্ছা। হেমন্ত বাংলা ঋতুচক্রের এক কাব্যিক উপাখ্যান। সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যে হেমন্ত যেমন সুন্দরের কাব্য শশি তেমনি কৃষি ভুবনের চৌহদ্দিতে কাজে কর্মে ব্যস্ততায় এক স্বপ্নীল মধুমাখা আবাহনের অবতারণা করে। সোনালী ধানের সম্ভার সৃঘ্রাণে ভরে থাকে বাংলার মাঠ প্রান্তর। কৃষক মেতে ওঠে ঘাম ঝরানো সোনালী ফসল কেটে মাড়াই ঝাড়াই করে শুকিয়ে গোলা ভরতে আর সাথে সাথে শীতকালীন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই কার্তিক মাসে সমন্বিত কৃষির সীমানায় কোন কাজগুলো আমাদের করতে হবে।
আমন ধান
- এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে।
- আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ্য সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালমত শুকাতে হবে।
- শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিস্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করতে হবে।
- পরিস্কার ঠান্ডা ধান বায়ু রোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
- বীজ রাখার পাত্র টিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখতে হবে।
- পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে মিশিয়ে দিতে হবে।
গম
- কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিতে হয়।
- দো-আঁশ মাটিতে গম ভাল হয়।
- অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিত জাত যেমন- আনন্দ, বরকত, কাঞ্চন, সৌরভ, গৌরব রোপন করতে হবে।
- বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাক নাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে।
- সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে।
- ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরীর শেষ চাষের সময় এবং ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভাল ফলন পাওয়া যায়।
আখ
- এখন আখের চারা রোপনের উপযুক্ত সময়।
- ভালভাবে জমি তৈরী করে আখের চারা রোপন করা উচিত।
- আখ রোপনের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সে.মি থেকে ১২০ সে.মি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সে.মি। এভাবে চারা রোপন করলে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০ চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
- ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে এবং জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে।
- ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
- কার্তিক মাস সরিষা চাষেরও উপযুক্ত সময়।
- সরিষার প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে টরি-৭, রাই-৫, কল্যাণীয়া, সোনালি, সম্পদ, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮ উল্লেখযোগ্য।
- বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে টরি-৭, বারি সারিষা-৯ বা কল্যাণীয়া টিএস-৭২ রোপণ করুন।
- জাতভেদে সামান্য তারতম্য হলেও বিঘাপ্রতি গড়ে ১ থেকে ১.৫ কেজি সরিষার বীজ প্রয়োজন হয়।
- বিঘা প্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়।
- সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
আলু
- আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় এ মাসেই।
- হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
- ভাল ফলনের জন্য বীজ আলু হিসেবে যে জাতগুলো উপযুক্ত তাহলো ডায়মন্ড, মুল্টা, কার্ডিনাল, প্যাট্রেনিজ, হীরা, মরিণ, অরিগো, আইলশা, ক্লিওপেট্রা, গ্রানোলা, বিনেলা, কুফরীসুন্দরী এসব।
- প্রতি বিঘা জমি আবাদ করতে ৬০০-৮০০ কেজি বীজ আলুর দরকার হয়।
- এক বিঘা জমিতে আলু আবদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমান জমির অবস্থাভেদে কম-বেশি হতে পারে। তাছাড়া বিঘাপ্রতি ৪-৫ টন জৈব সার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়।
- আলু উৎপাদনে আগাছা পরিস্কার, সেচ, সারের উপরি প্রয়োগ, মাটি অলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ।
- বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।
মিষ্টি আলু
- নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকুতির মাটিতে মিষ্টি আলু ভাল ফলন দেয়।
- তৃপ্তি, কমলা সুন্দরী, দৌলতপুরী, বারি মিষ্টি আলু-৪, বারি মিষ্টি আলু-৫, বারি মিষ্টি আলু-৬, বারি মিষ্টি আলু-৭, বারি মিষ্টি আলু-৮, বারি মিষ্টি আলু-৯, বারি মিষ্টি আলু-১০, বারি মিষ্টি আলু-১১, বারি মিষ্টি আলু-১২ ও বারি মিষ্টি আলু-১৩ আধুনিক মিষ্টি আলুর জাত।
- প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খন্ড লতা পর্যাপ্ত।
- বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।
ডাল ফসল
- মুসুর, মুগ, মাসকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন।
- এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময় মত বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।
শাক-সবজি
- শীতকালীন শাকসবজি চাষের উপযুক্ত সময় এখন।
- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীজতলায় উন্নতজাতের দেশী-বিদেশী ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমাটো, বেগুন এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে।
- আর গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে এখন মূল জমিতে চারা রোপন করতে পারেন।
- মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে শীতকালীন শাকসবজি রোপণ করতে হবে।
- এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- রোপনের পর আগাছা পরিস্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করতে হবে।
- তাছাড়া লালশাক, মূলাশাক, গাজর, মটরসুটির বীজ এ সময় বপন করতে পারেন।
অন্যান্য ফসল
- অন্যান্য ফসলের মধ্যে এ সময় পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ধনিয়া, কুসুম, জোয়ার এসবের চাষ করা যায়।
- সাথী বা মিশ্র ফসল হিসেবেও এসবের চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
- বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে জমিতে পানি কচু বপন করতে পারেন।
- সেচ নালা সংস্কার ও মেরামত করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
- সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায়।
- রাণীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
- গত মাসে ফুটানো মুরগির বাচ্চার ককসিডিয়া রোগ হতে পারে। রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা করাতে হবে।
- গবাদিপ্রাণির আবাসস্থল মেরামত করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- গবাদিপ্রাণিকে খরের সাথে তাজা ঘাস খাওয়াতে হবে।
- ভুট্টা, মাসকালাই, খেসারি রাস্তার ধারে বা পতিতজায়গায় বপন করে গবাদিপ্রাণিকে খাওয়ালে স্বাস্থ্য ও দুধ দুটোই বাড়ে।
- রাতে অবশ্যই গবাদিপ্রাণিকে বাহিরে না রেখে ঘরের ভিতরে রাখতে হবে। তা নাহলে কুয়াশায় ক্ষতি হবে।
- গবাদিপ্রাণিকে এ সময় কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে।
- এছাড়া তড়কা, গলাফুলা রোগের বিষয়ে সচেতন থাকলে মারাত্মক সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
মৎস্যসম্পদ
- এ সময় পুকুরে আগাছা পরিস্কার, সম্পূরক খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
- জাল টেনে মাছের স্বাস্থ পরীক্ষা করাও জরুরী।
- রোগ প্রতিরোধের জন্য একরপ্রতি ৪৫-৬০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে পারেন।
- অংশঅদ্বারিত্বের জন্য যেখানে যৌথ মাছ চাষ সম্ভব নয় সেখানে খুব সহজে খাঁচায় বা প্যানে মাছ চাষ করতে পারেন।
- এছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শীতকাল আমাদের কৃষির জন্য একটি নিশ্চিত মৌসুম। যতবেশি যৌক্তিক বিনিয়োগ করতে পারবেন লাভও পাবেন তত বেশি। শুকনো মৌসুম বলে মাটিতে রস কম থাকে। তাই যদি প্রতি ফসলে চাহিদা মাফিক সেচ প্রদান নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে আপনার জমির ফলন অনেক বেড়ে যাবে। একমাত্র কৃষির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আধুনিক কৃষির সবকটি কৌশল সঠিক সময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত গস্তব্যে পৌছতে পাবরো। কৃষির যে কোন সমস্যায় ১৬১২৩ নম্বরে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা।
কৃপ্র/ এম ইসলাম