‘প্রকল্পে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন , জাপান ও মালয়েশিয়া’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ আগামী বছরের মধ্যেই গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু করতে চায় সরকার। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের সহযোগিতাও প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। ভারতের পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পেশ করা হবে। এরপরেই গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ খুলবে বলে আশা করা হচ্ছে। খবর জনকণ্ঠ অনলাইনের।
ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের পরিচালক ভুপাল সিংয়ের নেতৃত্বে আট সদস্যের প্রতিনিধি দল গত মঙ্গল ও বুধবার রাজবাড়ীতে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বৃহস্পতিবার ঢাকায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কয়েক দফা বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। ভারতের পানি কমিশনের প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যেই দিল্লী ফিরে গেছেন। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বিষয়ে তারা একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করবেন। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বিভিন্ন দিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশের আমন্ত্রণেই এই প্রতিনিধি দল রাজবাড়ীর গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন সূত্র জানায়, ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের পরিচালক ভুপাল সিংয়ের নেতৃত্বে দেশটির প্রতিনিধি দল রাজবাড়ীর গঙ্গা প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন। প্রতিনিধি দল ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গেও বৈঠক করেন।
গত বছরের ২৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের এক বৈঠকেও গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি আলোচনা হয়। পদ্মা নদীর উপর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়েও উভয়েই একমত পোষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই ব্যারাজ নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এছাড়া ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত পরামর্শ সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের নিকটও গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তখন তিনি গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের জন্য ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আসার জন্যও আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে ভারতের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ আগে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ করুক। তারপর ভারতীয় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে যাবেন। এরপর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প শেষ করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য তাদের সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া যৌথ নদী কমিশনের ৩২, ৩৩ ও ৩৪তম বৈঠকেও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়।
গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে পাঁচ বছরের মধ্যেই ব্যয়িত অর্থ উঠে আসবে। এদিকে জাপান, চীন ও মালয়েশিয়া এই প্রকল্পে সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উভয় দেশেরই লাভ হবে। দুই দেশের অভিন্ন নদী বেঁচে থাকলে সকলেরই লাভ হবে। এছাড়া এই ব্যারাজ বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর সুন্দরবন উভয় দেশেরই সম্পদ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নদীর পলিমাটি অপসারণ, নাব্য ও প্রবাহ বৃদ্ধি, লবণাক্ততা হ্রাস, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ কৃষির উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের প্রাথমিক অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটি অনুমোদনের চার বছর পর ২০০৯ সালের মার্চ মাসে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনটি সরকারের নিকট ইতিমধ্যেই পেশ করা হয়েছে।
রাজবাড়ী জেলার পাংশায় এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে। ব্যারাজটি হবে নীলফামারীর ডালিয়ায় নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের আদলে। ব্যারাজ থেকে উজানে ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকবে বিশাল পানি রিজার্ভার। যার পানি ধারণক্ষমতা থাকবে দুই হাজার ৯০০ মিলিয়ন মিটার কিউব। এই পরিমাণ পানি থেকে ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে দুই হাজার মিলিয়ন কিউসেক মিটার পানি সরবরাহ করা হবে।
গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ হলে গঙ্গানদীনির্ভর এলাকার মানুষের জীবিকার প্রসার, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন তথা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন হবে। প্রকল্পের অধীনে ১১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পানিবিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলে পোল্ডারসমূহে ব্যাপক জলাবদ্ধতারও নিরসন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩৭ শতাংশ এলাকার কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনসহ নৌ-যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
দুই হাজার ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের গঙ্গা নদীর বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ২৪০ কিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর সাতটি জেলার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির প্রাপ্ত পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে গঙ্গানির্ভর নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী নদীসমূহের মধ্যে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। যার ফলে ওই এলাকার বিশাল অঞ্চলে সেচের ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এছাড়া মূল ব্যারাজ ও গড়াই অফটেক স্ট্রাকচারে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে সেচ সমস্যার সমাধান ছাড়াও ওই এলাকায় অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং প্রতিবছর দুই দশমিক চার লাখ মেট্রিক টন মাছচাষ করা যাবে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী প্রকল্পটির কাজ পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করা হবে। এই ব্যারাজ নির্মাণ হলে আয় হবে প্রতিবছর ৭ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা। দীর্ঘমেয়াদে এই আয় আরও বৃদ্ধি পাবে।
সূত্র জানায়, গঙ্গা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশে ৫১ দশমিক ৪৭ লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১৯ লাখ হেক্টর জমি এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের আওতায় চলে আসবে। প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে দুই হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট মূল ব্যারেজ, ৭৮টি স্পিলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক, দুটি ফিসপাস ও অন্যান্য স্থাপনা। অপরদিকে এ প্রকল্পের আওতায় গড়াই অফটেক স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ৩৯০ মিটার। এখানেও ১৫টি স্পেলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক ও একটি হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে।
গঙ্গা ব্যারাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মাধ্যমে ১২ মাস পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে বড় ধরনের বিপ্লব নিয়ে আসবে। পরিবেশে ফিরে আসবে ভারসাম্য। ব্যারাজটি নির্মাণ হলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে। সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এটি নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি এন্ড ডিটেইল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফর গ্যাঞ্জেস ব্যারাজ প্রজেক্ট’-এর আওতায় সমীক্ষা চালানো হয়। ডেভেলপমেন্ট এন্ড ডিজাইন কনসালট্যান্ট নামক একটি দেশী প্রতিষ্ঠান এই ব্যারাজ নির্মাণে সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কাজটি করে। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ও চীনের বিশেষজ্ঞরাও জড়িত ছিলেন। সমীক্ষা শেষে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবেদন পেশ করে।
এদিকে জানা গেছে, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নে জাপান, চীন ও মালয়েশিয়া সরকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনের ‘থ্রি গর্জিয়াস’ নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই এ প্রকল্প নির্মাণে প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশী অর্থ সহায়তা নেয়া হবে কি-না এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।
গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে বছরজুড়েই পানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। দেশে এই প্রথম এরকম একটি ব্যারাজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ৩ থেকে ৪ মাস পানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর কৃষকরাও সুবিধা পেয়ে থাকেন নির্দিষ্ট ওই সময়েই। তবে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ হলে বছরজুড়েই পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম