কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য শাকসবজি ও ফলমূলের উপর নির্ভর করে। মাছ, মাংস ও ডিমের তুলনায় শাকসবজি দামে কম বলে মানুষ তার পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য শাকসবজির ওপর নির্ভর করে। তাই আমাদের দেশে প্রায় সব অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরণের শাকসবজি ও ফলের চাষ হয়। গিমা কলমি একটি পাতা জাতীয় গ্রীষ্মকালীন শাক। সেচের সুবিধা আছে এরকম যে কোন জমিতে গিমা কলমি চাষ করা যায়। গিমা কলমির বীজ একবার বপন করে প্রায় সারাবছর শাক পাওয়া সম্ভব।
গিমা কলমিতে ভিটামিন ‘এ’ আছে। গিমা কলমি এক ধরণের সুস্বাদু পাতা জাতীয় সবজি। শহর, গ্রাম সবখানেই গিমা কলমির যথেষ্ট চাহিদা আছে। গিমা কলমি চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বাড়তি আয় করা সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। গিমা কলমি বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে
গিমা কলমি উৎপাদন কৌশল ও জাত
বারি গিমা কলমি-১
১. ১৯৮৩ সালে বারি গিমা কলমি-১ জাতটি চাষের জন্য অনুমোদন করা হয়।
২. পাতার বোঁটা ও কান্ড সবুজ, নরম ও রসালো।
৩. পাতা ৬-৯ সে.মি. লম্বা ও ৫-৮ সে.মি. চওড়া।
৪. কলমির ফুল সাদা।
৫. বীজের আবরণ শক্ত, রং ধূসর। একটি ফলে চারটি বীজ থাকে।
৬. একবার বীজ বপন করে সারাবছর শাক সংগ্রহ করা সম্ভব।
চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু | মাটির প্রকৃতি |
বছরের যে কোন সময়ে গিমা কলমি চাষ করা যায়। তবে চৈত্র মাস (মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি) থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাস (জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি) বীজ বপনের জন্য উপযুক্ত সময়। | পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এরকম উর্বর জমি গিমা কলমি চাষের জন্য উপযোগী। তবে দো-আঁশ বা পলি দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য বেশি উপযোগী। |
জমি তৈরি ও বীজ বপন
১. বীজ বপন করার আগে নির্বাচিত জমি ৬টি চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে।
২. জমি গভীর করে চাষ করতে হবে।
৩. গিমা কলমির বীজ ছিটিয়ে ও সারিতে বপন করা যায়।
৪. সারিতে বীজ বপন করতে হলে জমিতে ২০ সে.মি. দূরে দূরে সারি তৈরি করে নিতে হবে।
৫. সারিতে ১৫ সে.মি. পর পর গর্ত করে ২/৩টি বীজ বপন করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
৬. ২/৩টি বীজ এক জায়গায় বপন করতে হবে যাতে একটি বীজ কোন কারণে অঙ্কুরিত না হলেও অন্য বীজ অঙ্কুরিত হতে পারে।
সার প্রয়োগঃ কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে গিমা কলমি চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশে-পাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ
১. গিমা কলমি চাষের জন্য বর্ষাকালে সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না।
২. তবে বর্ষাকালে এক নাগাড়ে বৃষ্টি না হলে ১০-১৫ দিন পর পর অবশ্যই পানি সেচ দিতে হবে।
৩. গিমা কলমি চাষের জন্য শীতকালে পানি সেচের প্রয়োজন হয়।
রোগবালাই ও তার প্রতিকার
জমিতে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময়ে পরিচর্যা
১. ছিটিয়ে বীজ বপন করলে চারা গজানোর পর প্রতি বেডে ১৫ সে.মি. পর পর একটি করে চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে।
২. জমিতে আগাছা জন্মাতে দেওয়া যাবে না। আগাছা জন্মালে তা নিড়ানির সাহায্যে তুলে ফেলতে হবে।
৩. বীজ ফসল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পাতার আকার, আকৃতি, রঙ ইত্যাদি অন্যরকম হলে তা উঠিয়ে ফেলতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
সাধারণত গিমা কলমির বীজ বপনের এক মাসের মধ্যেই ফসল সংগ্রহের উপযোগী হয়। এক মাস পরে গাছের আগার দিকের পাতা সংগ্রহ করতে হবে। এর পর প্রতি এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন পর পর পাতা সংগ্রহ করা যাবে। গিমা কলমির বীজ একবার বপন করে সারাবছর শাক সংগ্রহ করা যায়।
উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ঃ উন্নত পদ্ধতিতে গিমা কলমি চাষ করলে প্রতিবিঘা জমি থেকে প্রায় ৬ টন সবজি পাওয়া যায়।
বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণঃ ছোট দিনে এবং ঠান্ডা আবহাওয়ায় গিমা কলমির ফুল ফোটে। ফাল্গুন মাসে বীজ সংগ্রহের উপযোগী হয়। বীজ সংগ্রহের পর তা মচমচে করে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে হালকাভাবে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। তারপর বীজ ভালোভাবে ঝেড়ে ও রোদে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
গিমা কলমি উৎপাদন খরচ
১বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ফসল উৎপাদন খরচ
খরচের খাত | পরিমাণ | আনুমানিক মূল্য(টাকা) |
বীজ/চারা | ১ কেজি | ২০০ |
জমি তৈরি | চাষ ও মই | ৮০০ |
পানি সেচ | ৪ বার | ১০০০ |
শ্রমিক | ১০ জন | ১৫০০ |
সার | প্রয়োজন অনুসারে জৈব সার
|
এই সার বাড়িতেই তৈরি করা সম্ভব। তাই এর জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই। |
বিকল্প হিসেবে
টিএসপি=৬ কেজি (১ কেজি=২৩ টাকা) ইউরিয়া=২৮ কেজি (১ কেজি=১৫ টাকা) এমপি=৭.৫ কেজি (১ কেজি=২৮ টাকা) জিপসাম=৪ কেজি (১ কেজি=১২ টাকা) |
৮৫০ | |
কীটনাশক | প্রয়োজন অনুসারে জৈব বা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার | নিজস্ব/দোকান |
জমি ভাড়া | একবছর | ৪০০০ |
মাটির জৈব গুণাগুণ রক্ষা ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়তে পারে। |
মূলধন
এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে গিমা কলমি চাষের জন্য প্রায় ৫০০০ টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়স্বজন, সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।
প্রশিক্ষণঃ গিমা কলমি চাষ করার আগে এ চাষে অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে গিমা কলমি চাষের বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। এছাড়া চাষ সংক্রান্ত কোন তথ্য জানতে হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।পাতা জাতীয় সবজি হিসেবে গিমা কলমি একটি লাভজনক জাত। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করে গিমা কলমির ফলন বাড়ানো সম্ভব।
প্রশ্ন ১ : গিমা কলমি কি ?
উত্তর : গিমা কলমি একটি পাতা জাতীয় গ্রীষ্মকালীন শাক।
প্রশ্ন ২ : কোন মাটি গিমা কলমি চাষের জন্য উপযোগী ?
উত্তর : পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এরকম উর্বর জমি গিমা কলমি চাষের জন্য উপযোগী। তবে দো-আঁশ বা পলি দো-আঁশ
মাটি চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
প্রশ্ন ৩ : গিমা কলমি চাষের জন্য উপযুক্ত সময় কোনটি ?
উত্তর : বছরের যে কোন সময়ে গিমা কলমি চাষ করা যায়। তবে চৈত্র মাস (মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি) থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাস (জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি) বীজ বপনের জন্য উপযুক্ত সময়।
তথ্যসূত্র : কৃষি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, জুন ২০০৭, Microfinance for Marginal and Small Farmers (MFMSF) Project, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সেল-১, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), ঢাকা।
কৃপ্র/ এম ইসলাম