ড. কুয়াশা মাহমুদ: পৃথিবীতে অনেক উদ্ভিদ আছে যার গুনের কথা আমরা কয়জন জানি? গাছ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে এটা সত্য তবে সব গাছেরই গুনের ধরণ একই রকম নয়। আমরা এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি সব গাছেরই কিছু না কিছু গুন আছে। একটি বিশেষ ধরণের গুন সম্পন্ন গাছের কথা আজ কৃষি প্রতিক্ষণ এর পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল।
জিরো ক্যালরি মিষ্টি ফসল স্টেভিয়ার গুরুত্ব, উৎপাদন ও ব্যবহার
স্টেভিয়ার পরিচয়: স্টেভিয়া (Stevia rebaudiana Bert.) কম্পোজিটি (Compositae) পরিবারের অর্ন্তভুক্ত। ইহা ট্রপিক্যাল বা সাব-ট্রপিক্যাল ও কষ্টসহিষ্ণু বহু বর্ষজীবি (পেরিয়িাল) গুল্ম জাতীয় ঔষধি গাছ (চিত্র: ১)। পৃথিবীতে ২৪০টির মত প্রজাতি এবং ৯০টির মত জাত আছে। গাছটির অনেক শাখা প্রশাখা গজায়। মোটামূল মাটির নীচের দিকে গমন করে এবং চীকন মূলগুলি মৃত্তিকা পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। পাতাগুলি বিপরীদ দিকে অবস্থিত, খাজকাটা, আঁশালো ও গাঢ় সবুজ। ফুলগুলি সাদা, নলাকৃতি এবং উভয়লিঙ্গ।
গাছগুলি সুগন্ধ ছড়ায় না কিন্তু পাতাগুলি মিষ্টি। গাছটির উৎপত্তিস্থল প্যারাগুয়েতে ১৯৬৪ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ শুরু হয়। দক্ষিণ আমিরিকার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী এন্টোনিও বারটোনি (Antonio Bertoni) ১৯৮৭ সালে সেখানে প্রথম স্টেভিয়ার গাছ আবিস্কার করেন। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রাজিল, উরুগুয়ে, আমিরিকা, ইসরাইল, থাইল্যান্ড এবং চীনসহ প্রভৃতি দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। তাপমাত্রা ১৫০ সে. থেকে ৩০০ সে. এবং আর্দ্রতা ৬৫-৮৫% স্টেভিয়ার জন্য ভাল। বছরে ১৪০ সেমি. বৃষ্টিপাত হল ভাল হয়। ইহা স্বল্পদীর্ঘ দিবস উদ্ভিদ। স্টেভিয়ার গাছ সহজে উৎপাদন করা যায়। এমন কি মাটির টবে চাষ করা যায়। চিনির বিকল্প হিসাবে জিরো ক্যালরি স্টেভিয়ার পাতা ব্যবহার করা যায়। স্টেভিয়ার পাতা চিনি অপেক্ষা ৩০-৪০ গুন এবং পাতার স্টেভিয়াসাইড চিনি অপেক্ষা ৩০০ গুন বেশি মিষ্টি । ইহাকে মিষ্টি পাতা, মধুপাতা এবং মিষ্টি হার্ব প্রভৃতি নামে বলতে পারি।
স্টেভিয়ার গুরুত্ব:
(১) স্টেভিয়ার পাতা চিনি অপেক্ষা ৩০-৪০ গুন এবং পাতার স্টেভিয়াসাইড চিনি অপেক্ষা ৩০০ গুন বেশি মিষ্টি।
(২) ক্যালরিমুক্ত এই মিষ্টি ডায়াবেটিক রোগী সেবন করলে রক্তে গ¬ুকোজের পরিমান পরিবর্তন হয় না।
(৩) এটি প্যানক্রিয়েজ ইনসুলিন উৎপাদন উদ্দীপ্ত করে।
(৪) রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
(৫) এটি ব্যাকটেরিয়া সাইডাল এজেন্ট হিসাবে কাজ করে।
(৬) এটি খেলে দাঁতের ক্ষয়রোগ রোধ করে।
(৭) স্কিন কেয়ার (skin care) হিসাবে কাজ করে বিধায় ত্বকের কোমলতা এবং লাবণ্য বৃদ্ধি করে।
(৮) স্বাদ বৃদ্ধিকারক (Flavour enhancer) হিসাবে কাজ করে।
(৯) চা, কফি, মিষ্টি, দই, বেকড ফুড, আইসক্রিম, কোমল পানীয় ইত্যাদি তৈরীতে ব্যবহৃত হয়।
(১০) এটি ঔষধ তৈরীতে ব্যবহৃত হয়।
(১১) এর ভেষজ উপাদান মানুষের দেহে কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
চাষের জন্য উপযুক্ত মাটি, সময়, জমি তৈরী ঃ
দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি স্টেভিয়া চাষের জন্য বেশ উপযোগী। উচু জমি স্টেভিয়া চাষের জন্য ভাল। মৃত্তিকার পিএইচ ৬.৫ থেকে ৭.৫ থাকা ভাল। বছরের যে কোন সময় চাষ করা যায়। তবে জানুয়ারী থেকে মার্চ ( মধ্য পৌষ থেকে মধ্য চৈত্র) মাসে চাষ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে চাষ করলে ফলন বেশি হয়। জমি খুব ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরী করতে হয়। জমির অবস্থা ও মাটির প্রকারভেদে ৪-৬ টি চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ভালভাবে ঝুরঝুরা করে চাষ করতে হয়। চাষের মাঠ প্রয়োজনে মাঝে কিছুটা উচু করে তৈরী করলে ভাল যাতে বৃষ্টির পানি সহজেই নীচের দিকে গড়িয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত পানি নিস্কাষনের সুব্যবস্থা থাকা ভাল।
সারি ও গাছের দুরুত্বঃ
সারি থেকে সারির দুরত্ব ৫০-৫৫ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৫০-৫৫ সেমি করে রোপণ করা যেতে পারে। এক হেক্টর জমিতে ৪০,০০০ গাছ লাগানো যায়।
সার প্রয়োগ:
স্টেভিয়া গাছে খুব কম পরিমান সার প্রয়োজন হয়। মাটি পরীক্ষার পর প্রয়োজন মত সার প্রয়োগ করা ভাল। তবে অনুমোদিত গড় সারের মাত্রা হেক্টর প্রতি ১৪০ কেজি ইউরিয়া, ৪২ কেজি টিএসপি এবং ৩৫ কেজি এমপি (বিঘা প্রতি ২০ কেজি ইউরিয়া, ৬ কেজি টিএসপি, ৫ কেজি এমপি) । জমি চাষের সময় সমুদয় টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিযা ও এমপি সার তিন বারে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর ১ মাস পর হতে প্রতি মাসে ইউরিয়া ও এমপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন: আন্ত:পরিচর্যা:
প্রয়োজনমত জমিতে আগাছা দমন ও সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। চারা লাগানোর পর সতেজ চারার গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে চারার গোড়ায় অল্প মাটি তুলে দেওয়া যেতে পারে। মাঝে মাঝে মাটি আলগা করে দিলে ফসল ভাল হয়।
পোকামাকড় ও রোগবালাই: স্টেভিয়া চাষের ক্ষেত্রে পোকামাকড় এবং রোগবালাই এর তেমন কোন উপদ্রপ লক্ষ্য করা যায় না।
ফলন: মাঠে চাষ করলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হতে শুরু করে ভাদ্র-আশ্বিন মাস পর্যন্ত স্টেভিয়া গাছ হতে পাতা সংগ্রহ করা যায়। মাটির টবে লাগানো গাছ বড় হওয়ার পর সারা বছরই পাতা সংগ্রহ করা যায়। একটি মাটির টবে লাগানো গাছ হতে ৩০-৪০ গ্রাম সবুজ পাতা সংগ্রহ করা হয় যা হতে ৭-১০ গ্রাম শুকনা পাতার গুড়া পাওয়া যায়। মাঠে চাষ করলে গাছে ফুলের কুঁড়ি আসার পূর্বে এবং ফুলের কুঁড়ি দেখা দেওয়ার সাথে সাথে পাতা সংগ্রহ শুরু করতে হয়। সকাল বেলা পাতা সংগ্রহ করলে মিষ্টতা বেশি পাওয়া যায়। গাছের সমস্ত পাতা দুই – তিন বারে সংগ্রহ করা হয়। বিঘা প্রতি ৪৫০-৫৫০ কেজি সবুজ পাতা পাওয়া যায়। প্রতি বিঘা জমি হতে ১৫৫-১৯০ কেজি শুকনা গুড়া পাওয়া সম্ভব।
বংশবিস্তার: প্রকৃতিতে ইহা বীজ, মূলের বিভাগ এবং কান্ড লেয়ারিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার কওে । তাছাডা টিস্যু কালচারের মাধ্যমেও বংশবিস্তার করা স¤ভব হয়েছে অগভীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এ সাধারণ টেক্্রারের মাটি, অনুর্বর অম্লযুক্ত বালি মাটি এবং তৃণভূমিতেও জন্মাতে পারে। স্টেভিয়ার কুশি/কান্ডের টুকরা গুলির নীচের পাতা গুলি কেটে উপরের পাতা দুটি রেখে একটি ট্রেতে বালির মধ্যে বসানো হয়। লক্ষ্য রাখা হয় বালি যেন বেশাী ভেজা না থাকে অর্থাৎ বালিতে রসের পরিমান কম থাকে। বালিতে মাঝে মাঝে পানি দিয়ে হালকা রস রাখতে হবে। কয়েকদিন (৫-১০) পর কুশি ও শিকড় গজাতে থাকে। কুশি ও শিকড়সহ ট্রেটিকে ১০-১৫ দিন হার্ডেনিং সেডে রাখার পর বাইরে আনা হয় এবং পলিব্যাগে চারা করা হয়। প্রয়োজনমত সময়ে চারাগুলি মাঠে লাগানো হয়।
চারা লাগানোর পরপরই সেচ দিতে হয়। মাঠে মাঝে মাঝে হালকা সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বৃষ্টির পানি মাঠে জমা হলে তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক ড. কুয়াশা মাহমুদ, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই), ঈশ্বরদী।