‘বালাইনাশকের প্রভাবে মানুষ, গবাদিপশু, মৎস্য সম্পদসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক: খাদ্যের প্রতিটা সেক্টরেই আছে বিষের ছোঁয়া,বিষ ছাড়া যেন উৎপন্ন হয় না খাবারের কোনো কিছুই, আর বিষ আমদানি করতে বছরে ব্যয় হয় (প্রায়) ৬৩৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে বিদেশ থেকে পেস্টিসাইড বা বালাইনাশকের আমদানির পরিমাণ ৬৩৯ কোটি ৪১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই পেস্টিসাইড বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে চলে যায় তা কৃষকের কাছে থেকেই মানুষে দেহে।
আমরা নিত্যদিনের যে খাবার খেয়ে থাকি তা কোনো না কোনোভাবে পেস্টিসাইড ব্যবহার করেই উৎপন্ন করা হয়ে থাকে, উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৮ ধরনের ২২৮টি মাকড়ানাশক, ৭৯ ধরনের ১০১৫টি ছত্রাকনাশক, ১১৭ ধরনের ২৫৮৮টি কীটনাশক, ৫১ ধরনের ৬৯১টি আগাছানাশক, ২ ধরনের ১৩টি ইঁদুরনাশক, ৮৮ ধরনের ৭১৭টি জনস্বাস্থ্যকীটনাশক বিষ বাজারে রয়েছে । এছাড়াও ১৮টি নেমাটোডনাশক এবং গুদামজাত শস্যের পোকা দমনের জন্য ৪ ধরনের ৮৯টি বিশেষ কীটনাশক রয়েছে , মোট ৩৫৯ ধরনের ৫৩৫৯টি বালাইনাশক বা পেস্টিসাইট বাজারে বিদ্যমান আছে।
বাংলাদেশ ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জামার্নি, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই পেস্টিসাইড আমদানি করা হয়। যুক্তরাষ্টভিত্তিক পরিবেশ গবেষণা গ্রুপ- ওয়ের্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, কৃষি কাজে ব্যবহৃত কীটনাশকের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাই সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের রোগব্যাধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন ও রক্ষায় জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন প্রকার বালাইনাশকের প্রভাবে মানুষ, গবাদিপশু, মৎস্য সম্পদসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ আজ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। আমদানি করা বালাইনাশকের শতকরা ৬০ ভাগ শুধুমাত্র ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যা কোনো না কোনোভাবে মানুষে শরীরে প্রবেশ করে। তবে একক পরিমাণ জমিতে বালাইনাশকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়ে সবজি ফসলে। ফল ফসলে বালাইনাশক প্রয়োগের একটি নির্দিষ্ট সময় পর খাওয়া নিরাপদ । এ সময়কে বলা হয় অপেক্ষমাণ সময়। সব বালাইনাশকের অপেক্ষমাণ সময এক নয়।
অপেক্ষমাণকাল উত্তীর্ণ না হওয় পর্যন্ত শাক-সবজি অথবা ফল খাওয়া বা বাজারজাত করা উচিত নয়। ফসলভেদে এ অপেক্ষমাণ সময় কমপক্ষে ৩-৭ দিন, দেশে সবচেয়ে বেশি বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় শাক সবজি উৎপাদনে যা জনস্বাস্থ্যকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করার পর মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগেই শাক-সবজি বাজারে বিক্রির জন্য আনা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ না জেনে অল্প ধুয়েই তা খাবার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু কীটনাশকের বিষক্রিয়া এত প্রবল যে, ধোয়ার পরও তা থেকে যায়। ফলে খাবারের সঙ্গে মানবদেহে এবং খড়-কুটোর মাধ্যমে পশুর পেটে প্রবেশ করে সৃষ্টি করে নানান জটিল রোগ।
ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল) সমপ্রতি ফুলকপি, বেগুন, শিম ও লালশাকে কীটনাশকের ব্যবহারের উপর ভয়াবহ এক তথ্য উপস্থাপন করেছে। নমুনা শুধু রাজধানীর পাইকারি কাঁচাবজার থেকেই সংগ্রহ করেননি করেছেন নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগজ্ঞ, কাপাসিয়া, সাভার, কেরানিগঞ্জ, কালিয়াকৈর ও ধামরাই এর মত প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও। গবেষণায় দেখা গেছে ২৭টি ফুলকপির মধ্যে আটটিতে ম্যালাথিয়ন ক্লোরোপাইরিফস, প্যারাথিয়ন মিথাইল ধরনের কীটনাশক ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে। এই আটটির চারটি কৃষকদের কাছ থেকে নেয়া। এগুলোর সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১২-৩৬ গুণ পর্যন্ত কীটনাশক ছিল।
পাইকারি বাজার থেকে সংগৃহিত ফুলকপিতে ৩-৮ গুণ এবং খুচরা বাজারে ১০ গুণ পর্যন্ত কীটনাশক পাওয়া গেছে। ফুলকপিতে প্রতি কেজিতে ২০ মি. গ্রাম পর্যন্ত ম্যালাথিয়ন মানবদেহের জন্য সহনীয়, কিন্তু পাওয়া গেছে ৭২৯ মি.গ্রা পর্যন্ত। আবার ক্লোরোপাইরিফস প্রতি কেজিতে ৫০ মি.গ্রাম পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১৬০৫ মি.গ্রাম পর্যন্ত। বেগুনের ২৭টি নমুনার ১২টিতে কুইনালফস পাওয়া গেছে ১৪ গুণ বেশি, প্রতি কেজিতে কুইনালফস ১০ মি.গ্রাম পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১২৪.২৪ মি.গ্রাম পর্যন্ত। আমাদের দেশে শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাত ও গুদামজাতকরণের জন্য নির্বিচারে ডিডিটি, নগস, বাসুডিন প্রভুতি কীটনাশক ব্যবহার হয়। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে, শুঁটকি মাছে ব্যাপকভাবে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। এই বিষাক্ত উপাদান গরম পানিতে ধোয়ার পরও শুঁটকি মাছে থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ রান্না করা শুঁটকি মাছও কোনোভাবে বিষমুক্ত হচ্ছে না। ফলে তা চূড়ান্তভাবে মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে।
সুত্রঃ jaijaidinbd.com / কৃপ্র/ এম ইসলাম