এস এম মুকুল: প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি হালদা- বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী এবং এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরে চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় ৮০০ নদীর মধ্যে চট্টগ্রামের ছোট্ট একটি নদীর নাম হালদা। শুধু নামে নয় গুণেও অনন্য আমাদের এই হালদা নদী। স্মরণাতীতকাল থেকে হালদায় রুই, কাতলা, মৃগেলও কালিবাউশ ডিম ছেড়ে আসছে। প্রতি বছর বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের কোনো এক মুহূর্তে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। যুগে যুগে হালদা নদী অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
অর্থনৈতিক অবদান বিবেচনায় বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য হালদা নদী বাংলাদেশের জাতীয় মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্যের দাবিদারও বটে। প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি হালদা- বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী এবং এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, নদী থেকে পোনা আহরণের নজির থাকলেও হালদা ছাড়া বিশ্বের আর কোনো নদীতে ডিম আহরণের নজির নেই।
হালদার ইতিকথা
হালদা খালের উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ি র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে নামকরণ হয় হালদা। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে মানিকছড়ি, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িশ্চরের নিকট কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে। হালদার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫ কিলোমিটার। পানির উৎস মানিকছড়ি, ধুরং, বারমাসিয়া, মন্দাকিনী, লেলাং, বোয়ালিয়া, চানখালী, সর্ত্তা, কাগতিয়া, সোনাইখাল, পারাখালী, খাটাখালীসহ বেশকিছু ছোট ছোট ছড়া। নদীটির গভীরতা স্থান বিশেষ ২৫ থেকে ৫০ ফুট।
মৎস্য অর্থনীতিতে হালদার অবদান
হালদা নদী বাংলাদেশের সাদা সোনার খনি হিসেবেও পরিচিত। এ নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয়, যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস। জেনে রাখার মতো বিষয় হলো- ডিম থেকে উৎপাদিত রেণুু পোনা থেকে মাছ হিসেবে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাতে হালদা চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে হালদায় বর্তমানে মাছ যে পরিমাণে ডিম ছাড়ে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ডিম ছাড়ে কাতলা মাছ। ১৮ থেকে ২০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ ডিম দেয় প্রায় ৪০ লাখ। একটি মা-মাছ থেকে এক বছরে চার ধাপে আয় করা যায়। প্রথম ধাপে ডিম থেকে রেণু বিক্রি করে, দ্বিতীয় ধাপে ধানী পোনা বিক্রি করে, তৃতীয় ধাপে আঙ্গুলী পোনা বিক্রি করে, চতুর্থ ধাপে এক বছর বয়সে মাছ হিসেবে বাজারজাত করে।
গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিটি ধাপে ৪০ শতাংশ পোনার মৃত্যু হার বাদ দিয়েও একটি মা কাতলা প্রতি বছর হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার। এই হিসেবে হালদার প্রতিটি মা মাছকে একেকটি প্রাকৃতিক এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি বলেও অভিহিত করেন হালদা গবেষকরা। তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে- হালদায় এক সময় ৭২ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কালক্রমে পাঙ্গাশ, ঘনি চাপিলা, কইপুঁটি, বানী কোকসা, ঘর পুঁইয়া, গুইজ্জা আইর, বুদ বাইলাসহ অন্তত ১৫ (পনের) টি প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জানা গেছে, ১৯৪৫ সালে শুধু হালদা থেকেই ৫০০০ কেজি রেণু সংগ্রহ করা হতো। এক সময় হালদায় ২০-২৫ কেজি ওজনের কাতলা, ১২-১৫ কেজি ওজনের রুই এবং ৮-১০ কেজি ওজনের মৃগেল পাওয়া যেত। যা এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। মৎস্য অধিদপ্তরের সংকলন-২০১৩ থেকে জানা যায়, হালদা থেকে ১৯৪৫ সালে সংগৃহীত ডিম ১,৩৬,৫০০ কেজি এবং ৬৫ বছর পর ২০১১ সালে সংগৃহীত ডিম ১৩,০৪০ কেজি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরে চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৬ শতাংশ।
হালদা নিয়ে সিনেমা
মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের হালদা নদী ও এর আশপাশের মানুষের জীবনবৈচিত্র্য নিয়ে আজাদ বুলবুলের গল্পে অভিনেতা তৌকীর আহমেদের নির্মিতব্য নতুন ছবির নাম রাখা হয়েছে- হালদা। ছবির গবেষণার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম গুছিয়েও এনেছেন। পরিচালনার পাশাপাশি এটির চিত্রনাট্যও করছেন তিনি। খুব শিগগির এই ছবির অভিনয়শিল্পী বাছাইয়ের এবং শুটিং শুরু হবে বলে জানা গেছে।
সম্ভাবনার হাতছানি
একক নদী হিসেবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর অবদান সবচেয়ে বেশি। হালদাকে অাঁকড়ে থাকা প্রায় তিন হাজার জেলে পরিবারসহ জড়িয়ে আছে বিশ হাজার মানুষের জীবিকায়ন। নদী গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলত পরিবেশগত। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিম ছাড়ার উপযোগী প্রতিটি মাছের ওজন সর্বনিম্ন পাঁচ কেজি থেকে সর্বোচ্চ এক মন পর্যন্ত হয়।
এসব মাছ ডিম দেয় একসাথে ৫ থেকে ৪০ লাখ পর্যন্ত। বর্তমানে হালদা নদীতে মিঠা পানির ডলফিনসহ ৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। জানা গেছে, পঞ্চাশের দশকে দেশের মোট চাহিদার ৭০ ভাগেরও বেশি পোনার চাহিদা পূরণ করত হালদা। হালদাপাড়ের কালের সাক্ষী জেলেদের বয়ানে, আগে হালদার যে পরিমাণ মাছ ও ডিম পাওয়া যেত বর্তমানে তার এক-চর্তুথাংশও মেলে না। হালদা বিশেষজ্ঞদের গবেষণা অনুযায়ী, হালদার ৫ কেজি ওজনের ডিমওয়ালা একটি মাছ থেকে বছরে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তাই অপার সম্ভাবনাময় এ নদীকে ঘিরে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে জাতীয় অর্থনীতিতে শত কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা আছে।
হালদার গলদা
রুই জাতীয় মাছের পরে হালদার অন্যতম প্রধান মাছ হচ্ছে গলদা চিংড়ি। তবে হালদার গলদা চিংড়ির রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। গবেষকদের মতে, একটি পরিপক্ব গলদা চিংড়ি এক সঙ্গে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার ডিম ছাড়ে। জানা গেছে, কর্ণফুলীর মুখ থেকে মাদারীখালের মুখ পর্যন্ত জেলেরা গলদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করে যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠা গলদা চিংড়ি খামারগুলোতে সরবরাহ করে।
হালদা হতে পারে মেকং
হালদাকে তুলনা করা যেতে পারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদী মেকং-এর সঙ্গে। মায়ানমার, চীন, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড যৌথভাবে একটি সমন্বিত নদী কমিশন গঠন করে মেকং নদীতে মৎস্য চাষের মাধ্যমে তাদের সারা বছরের মাছের চাহিদা পূরণ করছে। জানা গেছে, মেকং নদীর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত সমন্বিত নদী কমিশনের যৌথভাবে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদী থেকে মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এর ফলে দেখা গেছে, নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত মাছ ধরার জন্য মেকং নদী উন্মুক্ত করে দিলে জেলেরা নদী থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করতে পারছে। প্রশ্ন হলো আমরা কেন দেশের অভ্যন্তরের মাছের খনি হালদা, কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীতে বছরের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মাছ শিকার বন্ধ করে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পারছি না? মৎস্য অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকার এ ব্যাপারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারে।
হালদাকে বাঁচাতে হবে
মৎস্য বিজ্ঞানীদের অভিমত, হালদার বাঁকগুলোতে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। বাঁকের পানি ওলট-পালটের মাধ্যমে মা মাছের সঙ্গে পুরুষ মাছের শুক্রাণু ভালোভাবে মিশ্রিত হয়। কিন্তু বাঁক কেটে নদীর স্রোত বৃদ্ধি পাওয়ায় মা-মাছের নিরাপদ প্রজননস্থল ধ্বংসের পাশাপাশি ডিম সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সঠিক পদক্ষেপের অভাব, মা-মাছ শিকার, বালু উত্তোলন, নদীর বাঁক কাটাসহ মাছের খনি হালদা নদীর প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দূষণের শিকার হয়ে মহা সংকটের সম্মুখীন। হালদা সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোকে সচেতন করা এবং মৎস্য বিভাগকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করলে বিশ্বের একমাত্র এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি টিকে থাকবে।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কৃষি বিশ্লেষক