মনজুর হোসেনঃ বিশ্বে তেল উৎপাদনে পামঅয়েল গাছ অনেক এগিয়ে রয়েছে। এই গাছ যদি আমাদের দেশে পাহাড়ি পতিত ভূমিতে এবং সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে সারাদেশে লাগানো যায় তবে ৫-৭ বছরের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠিতে পরিণত করা সম্ভব।
পামঅয়েল গাছ একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। রোপণের ৩-৪ বছরের মধ্যেই ফলন দিতে শুরু করে। ফলন শুরুর পর থেকে প্রতিমাসে একটি করে কাঁদি দেয় এবং সেই কাঁদি থেকে তেল সংগ্রহ করা যায়। এই গাছ একটানা ২৫-৩০ বছর পর্যন- ফলন দেয়। অন্য যেকোন ভোজ্য তেলের ফসল থেকে পাওয়া তেল অপেক্ষা এই তেল ১৫ গুণ বেশি হয়ে থাকে। ফুলটির মাংসল অংশকে বলা হয় মেসোকার্প যা থেকে পাম তেল আহরণ করা হয় আর বীজ বা শাঁশ থেকে পাওয়া যায় পাম কর্ণেল তেল। প্রতিটি পাম ফল থেকে ৯ ভাগ পাম তেল ও ১ভাগ পাম কর্নেল তেল পাওয়া যায়।
আমাদের দেশিয় পদ্ধতিতে সহজেই পাম তেল সংগ্রহ করা যায়। যেমন_ একটু পানিতে পাকা পাম ফল সিদ্ধ করে হাত দিয়ে চিপা দিলে তেল বের হয়ে আসবে। যদিও এই তেলে থাকবে পানির মিশ্রণ। মিশ্রণটি চুলায় জ্বাল দিলে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে এবং তেলটুকু থেকে যাবে।
বাংলাদেশের মাটি উর্বর। হেলায় ফেলায় চাষ করলেই অনেক ফসল জন্মে। তাইতো দেশে মাটিকে সোনার সাথে তুলনা করেছেন কবি। আমাদের দেশের এই মাটিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়- বেলে মাটি, এঁটেল মাটি ও পলি মাটি। বেলে মাটি আবার দুই প্রকার- বেলে চর ও বেলে দো-আঁশ। পাম গাছ চাষ করার জন্য তিন প্রকার মাটি-ই উপযোগী। পাম গাছ চাষের জন্য মাটিতে পিএইচ -এর ৪-৭ প্রয়োজন (পিএইচ বলতে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্বর পরিমাণকে বুঝায়)। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকার পিএইচ-এর মাত্রা ঠিক থাকায় পামঅয়েল গাছ চাষ সম্ভব।
পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে পামঅয়েল গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পামঅয়েল গাছ চাষে সামান্য পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। পাম ফল থেকে পাম তেল সংগ্রহের সময় যে পুষ্টিসমৃদ্ধ বর্জ্য পাওয়া যায় সেটাই সার হিসেবে পাম গাছে ও গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করার জন্য পামঅয়েল উদ্ভিদের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের করার জন্য জৈব পদ্ধতিই ব্যবহার করাই ভাল।
বিশ্বে এখন পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য “শূন্য বর্জ্য ও শূন্য দহন” পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এই গাছের পাতা, গুঁড়ির শূন্য কাঁদি ব্যবহার করে নতুন নতুন দ্রব্য উৎপাদন করা হচ্ছে। পাতা ও ডাল না পুড়িয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাম গাছের এক টন পাতা মাটিতে ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ১.০৬ কেজি ফসফরাস, ৯.৮১ কোটি পটাসিয়াম ও ২.৭৯ কেজি ম্যাগনেসিয়াম ফিরিয়ে দেয় এবং এই গাছ বাতাস থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে।
সারা বাংলাদেশে পামঅয়েল চাষ ছড়িয়ে দিতে সরকারকে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চাষাবাদ বাস-বায়িত করতে হবে। গণমাধ্যমকে প্রচারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে পামওয়েল গাছ চাষ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে পাম চাষের প্রসার ঘটাতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এবং পাবর্ত্য এলাকার উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন যে সব রস্তা আছে সে রাস্তার দুপাশে পামঅয়েল গাছ লাগানো যেতে পারে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মন্দির ও হাসপাতালের অব্যবহৃত জায়গায়ও পাম চাষ করা যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাবাদি পতিত জমি, পাহাড়ি অঞ্চল, চরাঞ্চল ও উপকূল অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ অভিযানের মাধ্যমেও পামঅয়েল চাষ করা যায়।
একটি পরিবারে দুইটি পামঅয়েল গাছ চাষ করলে ওই পরিবারের সারা বছরের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ হবে। প্রতিটি পরিবার যদি অয়েলপাম চাষে এগিয়ে আসে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের তেল আমদানি করতে হবে না।
বাংলাদেশ বছরে সাত লক্ষ টন পাম তেল আমদানি করে থাকে। যার মূল্য ১২ হাজার কোটি টাকা। আমরা যদি পামঅয়েল গাছ চাষের মাধ্যমে দেশে পাম তেলের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি, তাহলে দেশের ১২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব। এছাড়া অধিক উৎপাদনে আমরা বিদেশে রফতানি করে আয়ও করতে পারি বৈদেশিক মুদ্রা।
লেখক: মনজুর হোসেন,এগ্রিকালচার ফার্ম, কুমিল্লা
কৃপ্র/ এম ইসলাম