‘৫৩টি শাখা-প্রশাখা নদীর নব্যতা সঙ্কটে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বাংলাদেশ অংশে পদ্মায় জেগে উঠেছে বড় বড় চর ও ডুবোচর। ভারত গঙ্গা নদীতে (পদ্মা) বাঁধ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ফলে ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় ভরা যৌবন, পানি থৈই থৈই করছে। ভাটির বাংলাদেশ অংশে আশঙ্কাজনকভাবে পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফলে পদ্মার ৫৩টি শাখা-প্রশাখা নদীর নব্যতা সঙ্কটে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষিতে সেচ কাজ মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। খবর নয়া দিগন্ত অনলাইনের।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ফরাক্কা ব্যারেজের ভাটিতে মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরে আরো একটি ব্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লকগেট, বাঁধ ও ফিডার ক্যানেল। ফিডার ক্যানেল লম্বায় ৩৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার। ফারাক্কা বাঁধ থেকে গঙ্গার পানি এই ক্যানেল পথেই ভাগীরথীতে পৌছে দেয়া হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে ভাগীরথী-হুগলি নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ফিডার ক্যানেলে দৈনিক ৪০ হাজার কিউসেক পানি ছাড়া হয়। এক মজা নদীকে জীবন দিতে গিয়ে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো বৃহত্তম বাঁধ তৈরি করা হয়েছে ফারাক্কা বাঁধ তার মধ্যে অন্যতম। ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যেও কানপুর ব্যারেজ এবং উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য আরো প্রায় ৪০০ পয়েন্ট দিয়ে পানি সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুস্ক মওসুমে এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে।
সমুদ্র থেকে ৪২ ফুট উচুঁতে অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্ট থেকে ভারত সীমান্ত ত্রিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের আঠার কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ অবস্থিত। ভারতের গোমুখিতে ভূমিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশের মেঘনা সঙ্গম স্থান পর্যন্ত এক হাজার ৬৮০ মাইল ব্যাপী প্রবাহিত। মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে গঙ্গার মূল অংশ চলে আসে বাংলাদেশে। গঙ্গার স্রোত ধারার নাম পদ্মা রাজশাহী চারঘাটে প্রবেশ করে বেড়া উপজেলার নতিবপুরের কাছে বারকোদালিয়া নামক স্থানে যমুনা নদীর সাথে মিশেছে। এর মিলিত প্রবাহকে পদ্মা নামে অভিহিত। অবশ্য গঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই পদ্মা নামে পরিচিত।
শুধুমাত্র ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা সবকিছুতে মারাত্মক ক্ষতি করেছে। মিঠাপানি ছাড়া কৃষি তথা কোন ধরনের শিল্প-কারখানা চলতে পারে না। ফারাক্কার কারনে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। ফারাক্কার কারনে পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। গাঙ্গেয় পানি ব্যবস্থায় দুইশতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল। সেগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রুপ নিতে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য অনেক আগেই হুমকীর মুখে পড়েছে। পদ্মা সংযুক্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা, আত্রাই, বারনই, শিব, রানী ও ছোট যমুনাসহ ১২টি নদী ও ২০টি খালে এর প্রভাব পড়েছে। এসব নদী-খাল পলি ও বালু পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন মৃতপ্রায়। ফলে এ অঞ্চলের কৃষির সেচ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে বিরাজ করছে মরু রুক্ষতা।
পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে ভাটির বাংলাদেশে পানি তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দেখছেন, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী আত্রাই ও গড়াই নদীতে পানির টান পড়েছে। গড়াই নদীর কষ্টিয়া কয়ারা ব্রিজের নিচে বালু চর। জিকে প্রজেক্ট কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাবাঙ্গা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাই, হিনসা, কুমার, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মার ৫৩টি শাখা-প্রশাখা নদী নব্যতা সঙ্কটে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কোন স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রুপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছে অনেকেই। পদ্মার প্রধান শাখা নদী হলো মাথাভাঙ্গা, কুমার, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়ালখা প্রভৃতি। প্রশাখা হলো মধুমতি, পশুর, কপোতাক্ষ। উপনদী একটি মহানন্দা। মহানন্দা রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানায় পদ্মায় মিলিত হয়েছে। পদ্মার পানি দিয়ে শুকনো মওসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। এ নদীর পানি দিয়ে প্রায় ২০ ভাগ জমির সেচকাজ চলে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বানিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলেন, পানি প্রবাহের মাত্রা ৪০ হাজার কিউসেক হলে নদীতে আর পলি জমতে পারে না। তলদেশও ভরাট হয় না। প্রবাহ কম বলে পদ্মার বুকে মাইলের পর মাইল চর জেগে উঠছে। যশোর-কুষ্টিয়ার নদীগুলো পদ্মার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। পাবনার ইছামতি, চন্দ্রাবতী এবং রাজশাহী ও নাটোরের কয়েকটি নদী রয়েছে। পদ্মার প্রধান শাখা নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব, মাথা ভাঙ্গা, কুমার, কপোতাক্ষ, পশুর ও বড়াল।
সরেজমিন পাবনার মধ্য দিয়ে পদ্মার আর একটি শাখা নদী মরা পদ্মা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে মূল পদ্মা,গড়াই এবং পাবনার চাটমোহরের বড়াল, ছোট যমুনা, পূনভবা, আত্রাই, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, ভদ্রবতী, গোহালা, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন, কানেশ্বরী, সরস্বতী, মুক্তাহার ঝবঝবিয়া, ফুলজোর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানির প্রবল টান পড়ায় এই সব নদী শুকিয়ে গেছে। কোন কোন স্থানে হাটু পর্যন্ত পানি আছে। এলাকার প্রবীণ লোকদের মতে, ফারাক্কা ব্যারেজের আগে এই সব নদ-নদীতে সারা বছর পানি থাকতো। অপর দিকে তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে পানির টান পড়ায় যমুনা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পাবনা নগরবাড়ী, বেড়া-নাকালিয়া যমুনা নদীর বুক জুড়ে অসংখ্য ছোট বড় চর। বেড়ার নিকটবর্তী শাহজাদপুরে বাঘাবাড়ি ব্রিজের নিচে বড়াল নদীতে অসংখ্য চর পড়েছে। বড়াল নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় রাসায়নিক সারবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভিড়তে অসুবিধার মধ্যে পড়ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা জানান, বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠতো না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে- তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম