ড. মো. হুমায়ুন কবীর: বাংলাদেশের পাটের মূল আমদানিকারক হলো ভারত। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া ভালো পাট হয় এমন আরেকটি দেশ হলো নেপাল। সম্প্রতি ৫ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে সেই পাটের প্রধান আমদানিকারক হিসেবে ভারত বাংলাদেশ ও নেপাল হতে পাট আমদানি করার ক্ষেত্রে অ্যান্টি-ডাম্পিং কর আরোপ করেছে। সেই কর যদি স্বাভাবিক মাত্রাার বৃদ্ধি হতো তাহলে চিন্তার তেমন কিছু ছিলনা। কিন্তু দেখা গেছে বর্তমানে প্রচলিত আমদানি ট্যাক্স যেখানে টনপ্রতি ৮ মার্কিন ডলার ছিল, সেখানে এখন তা বৃদ্ধি করে ক্ষেত্রভেদে ৩৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত করেছে। তাহলে অংকের হিসাবে এ বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩৭৫%, যা অভাবনীয ও অকল্পনীয়।
এর অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশ থেকে যেন আর পাট আমদানি করতে না হয়, সেটিই তাহলে ভারতের মূল উদ্দেশ্য। তা না হলে একবারে এত বেশি পরিমাণ ট্যাক্স বৃদ্ধি করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। ভারত যুক্তি দেখাচ্ছে, তাদের দেশীয় পাটশিল্প ও পাটের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য শিল্প বাঁচানোর জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ থেকে কমমূল্যে পাট ভারতে আমদানি হলে সেখানকার কৃষি ও কৃষকেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পিছিয়ে যাবে বলে প্রচার করছে। আর সেজন্যই পাট আমদানির উপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি না করে বরং কৌশলে বাড়তি করারোপ করে কমিয়ে আনা।
কারণ ভারতে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় পাট একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাই সেখানে যদি ভারত সরাসরি পাট আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে আর্ন্তজাতিক সংস্থা হিসেবে ডব্লিউটিও, সার্ক, বিমসটেক, সাফটাসহ আরো কিছু আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতকে জবাবদিহি ও সমালোচনার শিকার হতে হবে। সেজন্য ভারত কৌশলে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
অথচ এ বিশেষ ও বেপরোয়া ধরনের ট্যাক্স আরোপের কারণে বাংলাদেশের পাটের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা জানি এক সময় পাট ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য যাকে সোনালি আঁশ বলা হতো। রপ্তানি আয়ের প্রায় সবটুকুই আসত পাট হতে। কিন্তু আধুনিক এ বিশ্বে পাটের চেয়ে সহজলভ্য এবং সস্তা অনেক কৃত্রিম তন্তু আবিষ্কার হওয়ায় বাংলাদেশের পাটের বিশ্ববাজারে গুরুত্ব হারাতে থাকে। সেইসাথে বাংলাদেশের কৃষি কাজে জলবায়ু পরিবর্তন এবং শস্য আবর্তন ও শস্যক্রমের কারণে পাট চাষ অনেকটা সংকোচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানের বাংলাদেশি অধ্যাপক ড. মাকসুদুল আলম পাটের জীবন রহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করার পর থেকে পাটের গুরুত্ব আবার বাড়তে শুরু করেছে।
জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এক বক্তৃতায় পাটের গুরুত্ব তুলে ধরেন, যার ফলাফল গত ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে বিশ্বখ্যাত জার্নাল ন্যাচার প্লান্টে প্রকাািশত হয়েছে । ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের পর তাঁরই নেতৃত্বে অ্যাক্রোফমিনা ফ্যাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন নকশা উন্মোচন করেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। সেজন্যই ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট মাকসুদুল আলমকে পাশে নিয়েই বাংলাদেশের বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের একটি বড় সাফল্যের খবর জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটি ছিল দেশি পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের খবর।
জিনোম হলো প্রাণি বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ঠের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার উপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণি বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট। গবেষণাগারে এই জিন বিন্যাস অদল-বদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব। এতে করে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন হলে পাট পচােেত কম সময় লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরী করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের আরেক দল গবেষকদের সাফল্যে আমেরিকায় অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (এনসিবিআই) পাটের আরো তিনটি জিনোম কোড পেয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে পাটের গুরুত্ব বাড়ার কারণে এর দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে কৃষকদের মাঝেও এর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। অপরদিকে দেশে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বন্ধ পাটকলগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে। পাটের উন্নয়নের উপর বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। সেইসাথে পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। তাছাড়া পাট মন্ত্রণালয় সতেরটি পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য পাটের ব্যাগ দ্বারা মোড়কীকরণ বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। সেজন্য এখন দেশেই পাটের অনেক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু সেখানে ঠিক এ সময়ে ভারত কর্তৃক এ পণ্যটির উপর এমন অ্যান্টি-ডাম্পিং কর আরোপ করে এসব কিছুকে নিরুৎসাহিত করবে। এতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পাট উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কারণ পাটের সুদিন ফেরার এ সময়ে ভারতের এমন একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যাপক তৎপর হয়ে দ্বিপাক্ষিকভাবে সম্ভব না হলে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের সহায়তা নিয়ে হলেও এর সুরুাহা করা দরকার।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়