কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার শবদলপুর গ্রামের জানবী রায়ের বিয়ে হয় দুই বছর আগে। স্বামীর সংসারে অবহেলার শিকার হয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। দরিদ্র বাবার বোঝা কমাতে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে কুঁচিয়া চাষের প্রশিক্ষণ নেন। ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাড়িতে একটি কুঁচিয়া খামার করেন তিনি। এখন বাড়িতে দুটি খামারের পাশাপাশি চারটি ঘেরে কুঁচিয়া চাষ করছেন জানবী রায়। প্রতি মাসে এ থেকে তার আয় ১৫-২০ হাজার টাকা। জানবীর মতো এ গ্রামের আট শতাধিক নারী গত দুই বছরে কুঁচিয়া চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পুরো জেলায় কুঁচিয়া চাষ করছে তিন হাজারের বেশি পরিবার।
গত কয়েক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে সাতক্ষীরার অধিকাংশ জমি পতিত কিংবা চিংড়িঘেরে পরিণত হয়েছে। জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে এ অঞ্চলে প্রচলিত ফসলের ফলন কমে গেছে। এতে গবাদি প্রাণী পালনও হুমকির মুখে পড়েছে। প্রতিকূল এ পরিস্থিতিতে জীবিকার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে কুঁচিয়া চাষ। এখন শবদলপুর গ্রামের প্রায় ৩০০ পরিবার জীবনধারণের জন্য পুরোপুরি কুঁচিয়া চাষের ওপর নির্ভরশীল। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এ গ্রামকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কুঁচিয়া পল্লী’ ঘোষণা করা হয়।
এ কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক প্রতিষ্ঠান (পিকেএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির ‘লিফট’ কর্মসূচির আওতায় আগ্রহী নারী-পুরুষদের কুঁচিয়া চাষে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কর্মসূচির অধীনে ২ হাজার থেকে ৪৯ হাজার টাকা পর্যন্ত সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হয়। উন্নয়ন সাতক্ষীরায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান বলেন, পরিবর্তিত জলবায়ুতে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে প্রচলিত ফসলের উত্পাদন শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে নতুন এ পদ্ধতি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। গো-চারণ ভূমির সংকটে এ অঞ্চলে গবাদিপশু পালনও হুমকির মুখে। প্রতিকূল এ পরিস্থিতিতে সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে কুঁচিয়া চাষ।
চাষীরা জানান, কুঁচিয়া চাষ বেশ সহজ; খাবারও কম লাগে। বাজারের কৃত্রিম খাবারের ব্যবহারও কম। শবদলপুর গ্রামের কুঁচিয়াচাষী পবন সরকার জানান, জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত জমিতে কুঁচিয়া চাষ লাভজনক। আগে বছরের কার্তিক থেকে মাঘ পর্যন্ত প্রাকৃতিকভাবে কুঁচিয়া সংগ্রহ করা হতো। উন্নয়নের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এখন এ গ্রামে সারা বছর কুঁচিয়া চাষ করা হয়। কুঁচিয়ার রোগ-ব্যাধি নেই বললে চলে। এ গ্রামের আরেক কুঁচিয়াচাষী সাবেত্রী মণ্ডল জানান, মাত্র ১০০ বর্গফুট আয়তনের একটি গর্তে তিন-চার মণ কুঁচিয়া চাষ করা যায়। চার-পাঁচ মাস পর কুঁচিয়া বিক্রি করা যায়। বর্তমান বাজারদরে এর মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় ২০-২৫ হাজার টাকা।
উন্নয়নের নির্বাহী পরিচালক এস এম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রকল্প এলাকায় আগ্রহী চাষীদের কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সহজ শর্তের ঋণ সুবিধা অসচ্ছলদের স্বাবলম্বী করেছে। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে উন্নয়নের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, কুঁচিয়া সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সাতক্ষীরার কুঁচিয়া ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, চীন, হংকং, তাইওয়ান ও কোরিয়ায় রফতানি হচ্ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে কুঁচিয়া রফতানি। ২০১১-১২ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকার কুঁচিয়া রফতানি হয়। গত অর্থবছর তা বেড়ে ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
পিকেএসএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জসিম উদ্দিন বলেন, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং দেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পিকেএসএফ কুঁচিয়া চাষের উদ্যোগ নেয়। বিদেশে কয়েকশ কোটি টাকার কুঁচিয়ার বাজার রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার্জনের পাশাপাশি এ অঞ্চলের দারিদ্র্য দূর করতে কাজ করছে পিকেএসএফ। এজন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করতে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/ এম ইসলাম