ড. মো. হুমায়ুন কবীর: ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি-বন্যা নিত্য-নৈমিত্তিক ও অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সে বৃষ্টি যদি আগাম হয় তবে সেটা সবসময় কল্যাণ বয়ে আনে না। এমনই একটি ঘটনা এবার ঘটেছে ভাটির দেশ, ধানের দেশ, গানের দেশ, প্রাণের দেশ হাওরে। গানের দেশ বলছি এজন্য যে, ভাউয়াইয়া, ভাটিয়ালি সুরের গানের টানে জন্য বিখ্যাত এলাকা হলো হাওর এলাকা। আর সেজন্যই শাহ্ আব্দুল করিম, হাছন রাজার মতো গানের যাদুকরের সৃষ্টি হয়েছিল সেসব এলাকায়। কারণ নৌকা বাইতে বাইতে মাঝিরা সেখানে লম্বা লম্বা সুরে গলা ফাটিয়ে সুর তুলে গানে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিরাট অংশ ভাটি এলাকার হাওর হিসেবে পরিচিত। বৃহত্তর সিলেটের জেলাসমূহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে এ বিশাল হাওর এলাকা গঠিত। এ এলাকার একটি বিশেষত্ব হলো সেখানে বছরে ৭ মাসই পানিতে তলিয়ে থাকে। বছরে মাত্র একটি ফসল বোরোধান উৎপাদিত হয়ে থাকে। এসময়ে সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই মিঠাপানির অনেক দেশি প্রজাতির মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত বিচিত্র ও বাহারি রকমের ধান ও মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।
এ অঞ্চলের একটি বড় রকমের দুঃখ হলো আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টি। প্রতিবছরে একমাত্র বোরো ফসল কাটার সময় এলেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে শিলাবৃষ্টি ও আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের। কিন্তু প্রতিবছরই কিছু না কিছু ফসল বিনষ্ট হলেও এবছর (২০১৭) অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন জরিপকারী সংস্থাসমূহ। সেখানে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় প্রায় দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমির ধান ফসল যার বারো আনা নষ্ট হয়েছে। সেখানে ৫ লক্ষাধিক মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়েছে যার বাজারমূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।
কৃষক সারাবছরের সঞ্চয় একসাথে করে জমা রাখে যাতে বোরো মৌসুমে ধান আবাদকালে চাষাবাদের খরচ যোগান দেওয়া যায়। শুধু তাই নয় সার, সেচ, কীটনাশক, আগাছা নাশক, শ্রমিকসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য এ সঞ্চিত অর্থ খরচ করা হয়। সেই সঞ্চিত অর্থই এ ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট না হওয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে দাদন ব্যবসা কিংবা মহাজনী কারবারীদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রয়োজনের সময় সহজ শর্তে ব্যাংক লোন পায় না। তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই কৃষকরা উচ্চসুদে বেসরকারী সংস্থা কিংবা জমিতে রেখেই নামেমাত্র মূল্যে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।
পাহাড়ি ঢলে উজান থেকে নেমে আসা বানের পানির তোড়ে সব ধরনের বাধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সেই বাধভাঙ্গা পানি যখন ধান ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন আর হাওরবাসীর কান্নার সীমা থাকে না। হাওরের ধানগুলো এমনিতেই নিচু এলাকায় হয়। সেখানে এত পরিমাণ নিচু যে সেখান থেকে আর পানি অন্যত্র নামিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। সেজন্য অল্প বৃষ্টিতেই মৌসুমের শুরুতেই ধানের জমিগুলো পানিতে তলিয়ে গিয়ে নষ্ট কওে দিয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
শুধুমাত্র মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত হাকালুকি হাওরেই নষ্ট হয়েছে ২৫ মেট্রিক টন বিভিন্ন বিরল প্রজাতির মাছ। বৃষ্টির পানিতে আধাপাকা ধানের গাছ পানির নিচে চলে যাওয়ায় সেখানে সেগুলো পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। সেই দুর্গন্ধে পানিতে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস সৃষ্টি হয়ে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা জানি রাসায়নিকভাবে কোন কিছুর নরমাল অর্থাৎ নিরপেক্ষ পানির পিএইচ-এর আদর্শ মাত্রা হলো ৭। কিন্তু এক্ষেত্রে পানির নিচে ধানের খড় পঁচে গিয়ে পানির স¦াভাবিক পিএইচ মান ৭ থেকে ৩-৪ এ নেমে গিয়ে পানি এসিডিক হয়ে পড়ছে। এতে মারা যাচ্ছে মাছসহ পরিবেশের জীববৈচিত্রের অন্যান্য সজীব উপাদানসমূহ।
জানা গেছে, এগুলো সমাধানের জন্য যদিও সংশ্লিষ্ট এলাকার মৎস্য ও কৃষি বিভাগ যৌথভাবে চুনসহ অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহার করে পানির স্বাভাবিক পিএইচ মাত্রায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তারপরও তড়িৎ কোন ফল পেতে দেরি হচ্ছে। তাই সেখানে মাছ মরে মরে ভেসে উঠছে। ঠিক সেকারণে বিষাক্ত মাছ ধরে যাতে জনস্বাস্থ্যের কোন সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেজন্য সেখানে সাতদিন মাছ ধারার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এসব এলাকায় মরে গিয়ে ভেসে উঠা মাছ খেয়ে সেখানকার পানিতে ভেসে বেড়ানো হাঁসগুলো মারা যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ পেয়েছে সেসব এলাকায় প্রায় পঁচিশলক্ষাধিক হাঁস পালন করে থাকেন সেখানকার কৃষকেরা। আর শুধু হাঁস কেন, সেখানে মারা পড়ছে অন্যান্য প্রাণী ও জীবজন্তু। কারণ এক অর্থে সেখানকার খাদ্য শৃঙ্খলে দেখা দিয়েছে এক প্রকার বিপর্যয়। একদিকে সেখানকার মানুষগুলো যেমন আশ্রয় ও খাবারহীন হয়ে পড়েছে, সেইসাথে আশ্রয় ও খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে সেখানকার গবাদিপশু সহ সকল প্রাণীকুল। সেখানে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী অন্যান্য জীব যেমন সাপ, গুইসাপ, ব্যাঙ, বিভিন্ন বিরল দেশি প্রজাতির মাছ ইত্যাদি সবগুলোই এখন হুমকীর সম্মুখীন।
সম্প্রতি পত্রিকান্তরের একটি খবর আরো বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। আর সেটি হলো আমাদের টাঙ্গুয়া হাওরের অদূরে পাশ্ববর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় স্থাপিত বিভিন্ন খনির উত্তোলন। সেখানে কয়লা থেকে শুরু করে মারাত্মক ইউরেনিয়াম পর্যন্ত রয়েছে। আর ইউরেনিয়াম হলো এমন একটি মারাত্মক রাসায়নিক যা কিনা পারমাণবিক চুল্লির উপজাত হিসেবে নিঃসৃত হয়ে থাকে। এ থেকে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়লে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে মেঘালয়ের এসব খনি থেকে উজানের ঢলের পানির ¯্রােতের সাথে যদি ইউরেনিয়ামসহ কোন ধরনের দূষিত রাসায়নিক আমাদের হাওরে চলে আসে তখন তা শুধু যে হাওরেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা কিন্তু নয়। তা তখন সারাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্যই একটি মারাত্মক হুমকী হিসেবে দেখা দেবে তাতে কোন সেন্দহ নেই।
এবারের ঘটনার পর সেখানকার বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা গেছে, এবারের আগাম বর্ষা ও বন্যা বিগত প্রায় ১২০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এত বিশাল ক্ষয়ক্ষতি স্মরণকালের মধ্যে আর জীবিত কারো চোখে পড়েনি। সেখানে কারো বাড়িতে ধান নেই, চাল নেই, নেই কোন নগদ অর্থকরি। চারিদিকে শুধু হাহাকার। কারণ একটি মাত্র বোরো ফসল আবাদের জন্য কৃষকরা তাদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করে থাকে। এখন তারা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
আমরা জানি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মোঃ আবদুল হামিদ সেই কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষ। তিনি সম্প্রতি শিকড়ের টানে সেসব বন্যাপীড়িত মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য সেসব এলাকা পরিদর্শন করেছেন যা আমরা গণমাধ্যমে প্রচারিত হতে দেখেছি। সেখানকার সরেজমিন পরিস্থিতি দেখে তিনি এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন যে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৯ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে একটি সমাবর্তনে যোগ দিতে এসেও সেই হাওর এলাকার মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর মনের বেদনার কথা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
বেশ কয়েকদিন যাবৎ বিয়টি গণমাধ্যমের অন্যতম একটি হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনা হওয়ার কারণে কথা উঠেছিল যে সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি কৃষক সংগঠন হাওরের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে দাবী দাওয়া করে আসা হচ্ছিল। সেখানে এখন খবর পাওয়া গেছে, সেখানে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সেখানে পরিবার প্রতি ন্যায্যমূল্যে ১০ টাকা কেজি দরে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
কেন হলো এবারের এমন ভয়াবহ অবস্থা? কারণ অন্যান্য বছরগুলোতে বর্ষাটা সাধারণত বৈশাখের শেষের দিকে শুরু হয়। কিন্তু এবার তা বৈশাখই শুধু নয় শুরু হয়েছে চৈত্রের শুরুতেই। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে এগুওেলাই আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। তাছাড়া হাওরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। সেখানে বেড়িবাধ, বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধসমূহ যখন সম্পন্ন হবে তখন এ ধরনের সমস্যা কম হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞগণ।
আমরা জানি প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর কারো কোন হাত নেই। তবে একে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছুটা মিনিমাইজ করা যায়। এগুলোকে মিনিমাইজ করার জন্য বর্তমানে সরকারেরর ইচ্ছায় হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। সেইসাথে ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি হাওরের কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিবিড়ভাবে গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য চালু করা হয়েছে হাওর কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র। আরো নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক সমন্বিত প্রকল্প। যেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের হয়তো হাওরের মানুষের এমন কান্না আর দেখতে হবে না। তবে এ মুহূর্তে আমাদের সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
যেকোন ধরনের সমস্যারই তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা কঠিন। বিগত দিনে অতীতের সরকারগুলোর পক্ষ থেকে এসব পিছিয়ে পাড়া জনগোষ্ঠীর দিকে কেউই দৃষ্টি দেয়নি। যদি আগে থেকেই এসব এলাকার মানুষের জন্য কাজ করার জন্য সমন্বিত ও সম্মিলিতভাবে দৃষ্টি দেওয়া যেত তাহলে এসব সমস্যার অনেকাংশেই অনেক আগেই সমাধান সম্ভব হতো। তবে আশার কথা দেরিতে হলেও যেহেতু এসব এলাকার সার্বিক উন্নয়নে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে সুফল একসময় আসবেই। তবে এসব গৃহীত অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পসমূহ যেন কোন দুর্নীতির কাছে হোঁচট না খায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ ইতোমধ্যেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধসহ অরো অনেক হাওর উন্নয়ন প্রকল্প নাকি একপ্রকার অমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লাল ফিতার চুরাবালিতে আটকে রয়েছে যা কোন অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। কারণ এগুলো দেখভাল করার জন্য বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্ব ব্যক্তি রয়েছেন।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
কৃপ্র/এম ইসলাম