ড. মো. হুমায়ুন কবীর: এবছর (২০১৬) সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়েছে। তার সুফল পেয়েছে সারাদেশবাসী। সেজন্য তারা কমদামে প্রচুর ইলিশ মাছ কিনে খেতে পেরেছে। মনে হচ্ছে ইলিশ যেন প্রকৃত অর্থেই জাতীয় মাছের আসল মর্যাদা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আবারো। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এর আগে ১৯৯৮ সালে এভাবে ইলিশ ধরা পড়েছিল বলে তথ্য দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। কারণ তখনপর্যন্ত নির্বিচারে এভাবে একদিকে ইলিশের বাচ্চা জাটকা এবং অপরদিকে ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা হতো না। তার সুফলই আসলে তখন পাওয়া যেত। এজন্য পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে শুরু হয় জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষার বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ। কিন্তু তারপরও জেলেদেরকে সামাল দিয়ে তা রক্ষা করা যাচ্ছিল না।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করা হতো। তারমধ্যে জাটকা নিধনরোধ, মা ইলিশ ধরা রোধ, কারেন্ট জাল বন্ধ করা, নির্দিষ্ট আকার ও আকৃতির ইলিশ মাছ ধরা রোধ করা, বিদেশে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোন কিছুতেই যেন কাজে আসছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থান এবং ইলিশ ধরা জেলেদের পুনর্বাসনের কিছু কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে এর আওতা সম্প্রসারণ করা হয়। সেখানে যতদিন জেলেরা ইলিশ মাছ ধরা থেকে বিরত থাকবে ততদিন সরকার থেকে তাদেরকে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করার কর্মসূচি নিয়েছে, যা ইতোমধ্যেই সফলতা দেখিয়েছে।
যখন গতবছর (২০১৫) পর্যন্ত দেখা গেল প্রজনন মৌসুমে ১৫ দিনের জন্য মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকার অব্যবহিত পরে মা ইলিশ ধরতে গিয়ে তখনও ইলিশের পেটে প্রচুর পরিমানে ডিম ছিল। সেজন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতে এবছর তা ১৫দিনের পরিবর্তে আরো একসপ্তাহ বাড়িয়ে ২২দিন করা হয়েছিল যা ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর ২০১৬ তারিখ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ইলিশের প্রজনন মৌসুম সাধারণত আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার আগে-পরে কয়েকদিন পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এবারো নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হওয়ার পর যখন মাছ ধরা হচ্ছিল তখনও অনেক ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা পড়তে দেখা গেছে। এতে করে নিষেধাজ্ঞার জন্য বর্তমানে নির্ধারিত ২২দিন সময় নিয়ে আবারো চিন্তা-ভাবনা করার কথা উঠে এসেছে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকসহ আরো অনেকে বলেছেন, ‘ইলিম মাছ সারাবছরই ডিম পাড়ে। তবে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে সামনে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে’। সেজন্য তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন বর্তমানের ২২ দিন সময়ও নিষেধাজ্ঞার জন্য যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে আরো কার্যকর এবং পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় ২২দিনের পরিবর্তে দেড় থেকে দুই মাস করলে সবচেয়ে ভালো ফল হয়। সেক্ষেত্রে আর কোন সংশয় ও শঙ্কা থাকবে না। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের ইলিশের জেলেদের জন্য মানানোও খুবই সহজ। কারণ জেলেরাও এর সুফল পেয়েছে। তারাও প্রয়োজনীয় ধৈর্য করতে রাজি আছে সরকারের গৃহীত জেলেবান্ধব পদক্ষেপের কারণে।
মা ইলিশের পাশাপাশি রয়েছে জাটকা ইলিশ ধরার বিষয়টি। সেই কাজের অংশ হিসেবে প্রতিবছর ১ নভেম্বর থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত ঝাটকা নিধন বন্ধ থাকবে সেটি নিশ্চিত করতে পারলে ফলাফল ভালো হবে। এবার নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইলিশ মাছ ধরা-বিক্রি, পরিবহন বন্ধ থাকায় এতদিন ইলিশ মাছ খোলাবজারেও বিক্রি বন্ধ থাকায় মাছ হিমঘরে রেখে দিয়েছিল জেলেরা। এখন আবার তা বাজারে উঠছে। দাম এসময়ে একটু বেশি হলেও মানুষের নাগালের বাইরে যায়নি।
সবচেয়ে বড়কথা বাজারে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে থেকে পাওয়া তথ্যে, এবারে ৪ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল, আর সবকিচু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর তা আরো বেড়ে সাড়ে চার লক্ষটন ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্বে মিঠাপানির মৎস চাষে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। অপরদিকে মাছের ৯৫ ভাগ রোগ মুক্তির ওষুধ আবিষ্কার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষনা কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী ড. লতিফুল বারী। তিনি শামুক, ঝিনুক, ডিমের পরিত্যক্ত খোলস, সজনার বীজ, কচুরি পাতার মূল ও ধানের কুড়ার ছাই ইত্যাদি হতে প্রাপ্ত উদ্ভাবিত শেল বর্জ্য ব্যবহার কওে কোন রকম রাসায়নিক উপাদান ছাড়াই এ ওষুধ প্রস্ততের ফর্মূলা আবিষ্কার করেছেন। এগুলো দেশের চলমান মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন গতিধারাকে আরো বেগবান করে এ খাতের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখতে পারবে। এভাবেই ফিরে আসবে ইলিশের সুদিন এবং সার্বিক মাছে আরো স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
লেখক: ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়