কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ‘জীবাণু সার’ বা জৈবসার মাটিতে বিভিন্ন পদার্থ একত্রে মিশ্রিত হয়ে জৈবসার উৎপন্ন করে যা মাটির উর্বরা শক্তি ১০ গুন বৃদ্ধি করে। জীবানু সার একটি উৎকৃষ্ট জৈবসার। জীবাণু সার বা জৈবসার ব্যবহারে ফসল উতপাদন ১৫% হতে ১৫০% বাড়ানো যায়। ইউরিয়া ও ফসফরাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে জীবাণু সার’ । ডাল জাতীয় শস্যের জমিতে জীবাণুসার ব্যবহার করলে ইউরিয়া প্রয়োগের কোনো প্রয়োজনই হবে না। আর ধানের জমিতে জীবাণু সার ব্যবহার করলে ইউরিয়ার সাশ্রয় হবে ২৫ শতাংশ। প্রায় ৫০ কেজি ইউরিয়া সারের কাজ করে দেয় মাত্র এক কেজি জীবাণু সার যার উৎপাদন খরচ হয় মাত্র ৭৫ টাকা!
জীবাণু সার কী?
ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যাকটিনোমাইসিটিস, শ্যাওলা এবং প্রোটোজোয়া। এই জীবাণুগুলো যখন সার তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে বলে জীবাণু সার। জীবাণু ব্যবহার করে সাধারণত তিন ধরনের জীবাণু সার তৈরি করা যায়। সারগুলো হলো- নাইট্রোজেন সংবনকারী জীবাণু সার, ফসফরাস দ্রবীভূতকারী জীবাণু সার এবং কম্পোস্ট তৈরিকারী জীবাণু সার।
কিভাবে কাজ করে জীবাণু সার :
ইউরিয়ার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় নাইট্রোজেন সংবনকারী জীবাণু সার। বাতাসে ৭৭.১৬ ভাগ নাইট্রোজেন থাকা সত্ত্বেও গাছ এ নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে না। মাটিতে রাইবোজিয়াম এবং ব্রাডি রাইবোজিয়াম নামক একধরনের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যারা সাধারণ অবস্খায় বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া দিয়ে তৈরি জীবাণু সার ডাল জাতীয় শস্যের জমিতে প্রয়োগ করলে কয়েক দিন পর দেখা যাবে ডাল গাছের শেকড়ে গুটি আকৃতির নাইট্রোজেনের নডিউল সৃষ্টি হয়েছে। এ নডিউলগুলো বাতাস থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন গ্রহণ করে গাছের নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করে। আর এ কারণেই ডাল জাতীয় শস্যের জমিতে জীবাণু সার ব্যবহার করলে কোনো ইউরিয়া দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
ধানের জমিতে ব্যবহারের জন্য তরল জীবাণু সারের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে বীজতলা থেকে ধানের চারা উঠিয়ে এর শিকড় জীবাণু সার দিয়ে ভিজিয়ে জমিতে রোপণ করতে হয়। ডাল জাতীয় শস্যের মতো জীবাণু সার ধানের শিকড়ে নাইট্রোজেন নডিউল তৈরি করতে পারে না। এ কারণে ধানের জমিতে শত ভাগ ইউরিয়ার বিকল্প হিসেবে জীবাণু সার ব্যবহার করা যায় না। বর্তমানে অ্যাজোলা নামক একধরনের জলজ ফার্ন ধানের জমিতে ইউরিয়ার বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। কারণ এ ফার্নটি নীল-সবুজ শ্যাওলার সাথে যুগ্মভাবে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংবন করতে পারে।
ফসফরাস দ্রবীভূত জীবাণু সারের কাজ গাছের ফসফরাসের চাহিদা পূরণ করা। মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণ ফসফরাস থাকে। গাছ এসব ফসফরাস সরাসরি মাটি থেকে গ্রহণ করতে পারে না। কারণ, ফসফরাস মাটিতে অন্যান্য মৌলের সাথে যৌগ গঠন করে থাকে। কিছু জীবাণু আছে যেগুলো ফসফরাসকে যৌগিক অবস্খা থেকে মুক্ত করতে পারে। এসব মুক্ত ফসফরাস গাছ সরাসরি মাটি থেকে গ্রহণ করতে পারে। ফসফরাস জীবাণু সার তৈরি করতে এসব জীবাণু ব্যবহার করা হয়।কম্পোস্ট তৈরিকারী জীবাণু সার কম্পোস্টের কাঁচামাল পচাতে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত কম্পোস্ট সার তৈরির সময় এর কাঁচামাল পচাতে ছয় মাসেরও বেশি সময় লাগে। কম্পোস্ট তৈরিকারী জীবাণু সার ব্যবহার করে এ কাজ মাত্র সাত দিনে করা সম্ভব।
বাংলাদেশে জীবাণু সার নিয়ে গবেষণা : জীবাণু সারের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৭৬ সালে প্রথম জীবাণু সার আবিষ্কার হয়। ১৯২০ সালে আমেরিকা জমিতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জীবাণু সারের উৎপাদন শুরু করে। বাংলাদেশে প্রথম জীবাণু সার নিয়ে গবেষণা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা (বিনা) ইনস্টিটিউট জীবাণু সার নিয়ে গবেষণা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত মোট সাত ধরনের জীবাণু সার উদ্ভাবন করতে সমর্থ হয়েছে। জীবাণু সারগুলো হচ্ছে, মসুরের জন্য বিনা-এলটি- ১৮, ছোলার জন্য বিনা-সিপি-২, বরবটির জন্য বিনা-সিওপি-৭, মুগ ডালের জন্য বিনা-এবি-১, চীনাবাদামের জন্য বিনা-জিএন-২ এবং সয়াবিনের জন্য বিনা- এসবি-৪। সব জীবাণু সার ২০০১ সালে সরকারের অনুমোদন পায় এবং চাষি পর্যায়ে বিপণন করা হচ্ছে।