কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : বাংলাদেশে রোপা আমন ধানের জাতসমূহ নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ দেশের নিচু থেকে মাঝারি নিচু জমি, যা মোট জমির শতকরা ২০ ভাগ, বর্ষাকালে আকস্মিক বন্যায় সম্পূর্ণ তলিয়ে যায় এবং এর মেয়াদ সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহ হয়। ফলে ধানের ফলন বন্যার তীব্রতা ভেদে আংশিক থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকগণ নতুন বীজতলা তৈরি করে অথবা পুরাতন বীতজলার বয়স্ক চারা রোপণ করে থাকেন। দ্বিতীয়বার চারা রোপণে কৃষকের অর্থ ও শ্রম যেমন ব্যয় হয় তেমনি দেরীতে রোপণে ফলনও কম হয়।
অনেক কৃষক চারার অভাবে কিংবা আর্থিক সংকটে পড়ে চারা রোপণ করতে পারেন না, ফলে তাদের জমি পতিত থেকে যায়। প্রতিবছর সরকারের একটি বিরাট অংকের টাকা কৃষি পুনর্বাসনে খরচ হয়ে থাকে। বন্যার পানিতে ডুবেও বেঁচে থাকার ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চফলনশীল ধানের জাত এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম। তাই অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাথে যৌথ সহযোগিতায় Stress Tolerant Rice for Africa and South Asia (STRASA) প্রকল্পের আওতায় বন্যার পানিতে ডুবেও বেঁচে থাকতে পারে এমন ধানের জাত ‘ব্রি ধান৫২’ উদ্ভাবন করেছে।
এ জাতটিতে বন্যার পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় বেঁচে থাকার বৈশিষ্ট্য বা জীন সাব ১ (SUB1) বিদ্যমান রয়েছে। ফলে এটি বন্যার পানিতে কমপক্ষে ১৪ দিন পর্যন্ত ডুবে থেকেও হেক্টর প্রতি ৪.০ টন ফলন দিয়ে থাকে। জাতটি বন্যা না হলে স্বাভাবিক ফলন হেক্টর প্রতি ৪.৫-৫.০ টন প্রদান করবে। বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর আকস্মিক বন্যা প্রবণ এলাকা রয়েছে যেখানে এই জাতের ধান চাষে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে।
জমি নির্বাচন:বন্যা সহিষ্ণু কৌলিক সারি বা জাতের জন্য জমি নির্বাচন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে সমস্ত এলাকায় বন্যার পানি এসে ৭-১৪ দিন পর্যন্ত থাকে এবং এর পর বন্যার পানি সরে যায় এমন আকস্মিক বন্যা প্রবণ জমি নির্বাচন করতে হবে। বন্যার পানি সরে যাবার পর ১০-১৫ সেন্টিমিটার (৪-৬ ইঞ্চি) পানি থাকা স্বভাবিক। তবে দীর্ঘ দিন ধরে প্রায় ৩৫-৪০ সেন্টিমিটার (১২-১৬ ইঞ্চি) এর বেশি পানি থাকে যাকে জলাবদ্ধতা বলে, এমন জমিতে এই বন্যা সহিষ্ণু জাত চাষ করা যাবে না। কেননা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত কোন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
বীজ বপনের সময়: ১৫-৩০ জুন অর্থাৎ ১-১৫ আষাঢ় (উত্তরাঞ্চল), ০১-১৫ জুলাই অর্থাৎ ১৫-৩০ আষাঢ় (অন্যান্য অঞ্চল)।
চারার বয়স: ৩০-৩৫ দিন।
বীজ বাছাই ও জাগ দেওয়া: রোগ, পোকা ও দাগ মুক্ত এবং পরিপুষ্ট বীজ হাত দিয়ে বেছে নিলে ভালো হয়। বীজ বাছাই এর কাজটি কৃষক পরিবারের সকলে মিলে অবসর সময়ে করতে পারেন। বাছাইকৃত সুস্থ-সবল বীজ থেকে উৎপাদিত চারা গুণগত মানসম্পন্ন হবে এবং বন্যার পানিতে যেমন কার্যকরভাবে টিকে থাকবে তেমন ফলনও বৃদ্ধি পাবে।
বাছাইকৃত বীজ ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে নিয়ে চটের ব্যাগ কিংবা ছালায় জড়িয়ে জাগ দিয়ে গজিয়ে নিতে হবে। ব্যাগ বা চট শুকিয়ে গেলে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে।
শতকরা ৮০ ভাগ গজানোর ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ পাতলা করে প্রতি বর্গমিটারে ৫০ গ্রাম বা শতকে ২ কেজি হারে বীজতলায় ফলতে হবে। এতে সবল, সতেজ ও মোটাতাজা চারা উৎপন্ন হবে এবং বন্যার পানি সহ্য করার ক্ষমতা বাড়বে।
বীজতলা তৈরি ও সার প্রয়োগ:ভালো মানের চারা পেতে আদর্শ বীজতলা তৈরি করা প্রয়োজন। আদর্শ বীজতলা তৈরি করার জন্য নিম্নের পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
সেচ সুবিধাযুক্ত এবং প্রচুর আলো-বাতাস পায় এমন স্থান বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে।
বীজতলার জমিতে এক সপ্তাহ আগে পানি ঢুকিয়ে চাষ ও মই দিয়ে ঘাস ও খড়-কুটো পচিয়ে নিতে হবে। অতঃপর ভালোভাবে জমি চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় বীজতলা তৈরি করতে হবে। সুস্থ-সবল ও মোটা তাজা চারার জন্য শেষ চাষের সময় নিম্নোক্তহারে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রতি শতাংশে প্রতি বর্গমিটারে
গোবর ৪০ কেজি ১ কেজি
ইউরিয়া ৫২৮ গ্রাম ১৩ গ্রাম
টিএসপি ২৫৩ গ্রাম ৬ গ্রাম
দস্তা ৮০ গ্রাম ২ গ্রাম
ফুরাডান ৫ জি ৪০ গ্রাম ১ গ্রাম
জমির একপাশ থেকে ১ মিটার (৩৯.৩৭ ইঞ্চি) চওড়া করে লম্বালম্বিভাবে বীজতলা তৈরি করতে হবে।
দুই বীজতলার মাঝে ৫০ সেন্টিমিটার (১৯.৬৯ ইঞ্চি) জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে এবং এই ফাঁকা জায়গা থেকে মাটি তুলে নিয়ে দুপাশের বীজতলাকে একটু উঁচু করতে হবে। এতে ফাঁকা জায়গায় নালার সৃষ্টি হবে। এই নালা দিয়ে প্রয়োজনে পানি সেচ দেয়া যাবে বা অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়া যাবে এবং নালায় প্রয়োজনীয় পানি ধরে রাখা যাবে।
বীজ বপনের আগে বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে বীজতলাকে ভালোভাবে সমান করে নিতে হবে।
গজানো বীজ পাতলা করে সমহারে বীজতলায় ফেলতে হবে।
বীজতলার পরিচর্যা:বীজ বপনের পর থেকে চারার শেকড় মাটিতে লেগে যাওয়া পর্যন্ত (৫-৭ দিন) সেচের পানি দিয়ে নালা ভর্তি করে রাখতে হবে। এতে বীজতলার মাটি নরম থাকে, গজানো বীজ নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে না এবং বীজতলাও শুকায় না।
বীজ বপনের ৫-৭ দিন পর বীজতলায় ছিপছিপে অর্থাৎ ২-৩ সেন্টিমিটার (১.০-১.৫ ইঞ্চি) পানি রাখা হলে চারার বাড়-বাড়তি ভালো হয়। পরে চারা বৃদ্ধির সংগে সমন্বয় রেখে পানির পরিমাণ ৩-৫ সেন্টিমিটার বাড়ানো যেতে পারে। তবে এর চেয়ে বেশি পানি রাখলে চারা লম্বা ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
কোনো কারণে চারার বৃদ্ধি কম হলে বা গাছ হলুদ হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম (শতাংশে ২৮০ গ্রাম) ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরেও হলুদ না কাটলে বুঝতে হবে সালফারের অভাব রয়েছে। তখন প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম (শতাংশে ২৮০ গ্রাম) জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। পাতায় ছিটছিটে দাগ হলে বুঝতে হবে দস্তার অভাব হয়েছে। এ জন্য প্রতি বর্গমিটারে ১ গ্রাম (শতাংশে ৪০ গ্রাম) হারে দস্তা সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
পোকার আক্রমণ দেখা দিলে অনুমোদিত হারে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। তবে চারা উঠানোর ২-৩ দিন আগে প্রতি শতাংশে ৪০ গ্রাম ফুরাডান/ভিটাফুরান ৫জি প্রয়োগ করলে পরবর্তীতে মাঠে পোকার আক্রমণ কম হবে।
জমি তৈরি ও প্রাথমিক সার প্রয়োগ:
চারা রোপণের দুই সপ্তাহ আগে জমিতে পানি ঢুকিয়ে চাষ ও মই দিয়ে আগাছা ও খড়-কুটো পচিয়ে নিতে হবে।
ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে এবং শেষ চাষোর আগে প্রাথমিক সার ছকে উল্লিখিত হারে প্রয়োগ করতে হবে।
রোপণ দূরত্ব: ২৫ x ১৫ সেমি (১০ x ৬ ইঞ্চি) অর্থাৎ সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার (৬ ইঞ্চি)।
জমির উর্বরতা ভেদে রোপণ দূরত্ব কম-বেশি করা যেতে পারে।
চারার সংখ্যা: প্রতি গোছায় ২টি করে সুস্থ, সবল ও মোটা তাজা চারা রোপণ করতে হবে।
শূণ্যস্থান পূরণ:জমির এক কোণায় বেলোনের মত ঘন করে কিছু চারা রোপণ করে রাখতে হবে। সাত-আট দিন পর সে চারা দিয়ে মরা চারার স্থলে (যদি থাকে) শূণ্যস্থান পূরণ করতে হবে। এতে করে শূণ্যস্থান পূরণকৃত ধানের ফুল একই সময় আসবে।
গাছ পরিস্কারকরণ ও আগাছা দমন:জমি থেকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গাছের পাতায় পলি কিংবা বালি জমা হতে পারে। ফলে পাতার ছিদ্র (Stomata) বন্ধ হয়ে পাতা জ্বলে সাদা হয়ে যেতে পারে। তাই পরিস্কার পানি হাত দিয়ে ছিটিয়ে বা স্প্রে মেশিন এর সাহায্যে গাছের পাতা ধুয়ে পরিস্কার করে দিতে হবে। কাজটি ঝামেলাপূর্ণ হলেও বন্যায় আক্রান্ত ধানের জন্য ভালো ফলাফল বয়ে আনবে।
জমি থেকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার কমপক্ষে ৭-১০ দিন পর জলজ আগাছাসহ অন্যান্য আগাছাসমূহ এবং ধানের পঁচা পাতা পরিস্কার করে দিতে হবে।
সার উপরি প্রয়োগ: বন্যার পানি সরে যাবার পর পরই ধান ক্ষেতে সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়। এতে ধান গাছ পচে যেতে পারে। তাই পানি সরে যাওয়ার ৭-১০ দিন পর জমি আগাছামুক্ত করে প্রথম কিস্তি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি হেক্টরে ইউরিয়া ৪৩.৫ কেজি (শতকে ১৭৬ গ্রাম) এবং এমপি সার ২৩ কেজি (শতকে ৯৫ গ্রাম) হারে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। অতঃপর কাইচ থোড় আসার পূর্বে আরেক দফা ইউরিয়া সার প্রতি হেক্টরে ৪৩.৫ কেজি (শতকে ১৭৬ গ্রাম) হারে প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। ভালো ফলন পেতে প্রতি চার গোছার মাঝে ০.৯ গ্রাম ওজনের ২টি করে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সম্পূরক সেচ: রোপণের পর থেকে কাইচ থোড়/ফুল আসা ও দুধ আসা পর্যন্ত জমিতে পানি থাকা জরুরী। এ সময় খরা হলে অবশ্যই সম্পূরক সেচ দিতে হবে। তবে ভালো ফলনের জন্য ধানের দানা বাঁধা অবস্হা পর্যন্ত সেচ দেয়া প্রয়োজন। পানি সেচের জন্য সেচ নালা রাখা দরকার। সেচ নালা না থাকলে আপনার ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ফিতা পাইফ সংগ্রহ করে সেচ প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা:অন্যান্য ধানের মতই বন্যা সহিষ্ণু কৌলিক সারি বা জাতের ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড় এর আক্রমণ হতে পারে। পোকা বা রোগ হলে তা দমনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পোকা দমন:অন্যান্য ধানের মতই ধান ক্ষেতে মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগী পোকা, গলমাছি, পামরি পোকা, গান্ধি পোকা এবং বাদামী গাছফড়িং / কারেন্ট পোকা ইত্যাদির আক্রমণ হতে পারে। পোকার আক্রমণ দিখা দিলে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থা (আইপিএম) অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনে কীটনাশক যেমন কুরাটার/ফুরাডান/ভিটাফুরান ৫জি, মার্শাল ২০ ইসি, সানটাপ ৫০ এসপি, ডায়াজিনন ৫০ ইসি ইত্যাদি পোকাভেদে অনুমোদিত হারে স্প্রে করে দমন করা যেতে পারে।
রোগ দমন:ধানে সিথব্লাইট/খোল পোড়া, ব্লাস্ট ও পাতার পোড়া দাগ হতে রোগ হতে পারে।
খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য ফলিকুর (টেবুকোনাজল) ১০ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করা যেতে পারে। এছাড়াও কনটাফ (হেক্সাকোনাজল) বা টিল্ট (প্রপিকোনাজল) স্প্রে করা যেতে পারে। প্রথম স্প্রে করার ৭ দিন পর আর একবার স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
ধান কাটা:শিষের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ৮০ ভাগ ধানের দানা সোনালি রং ধারণ করলে ধান কাটা যাবে।
ধানের ফলন:উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ব্রি ধান৫২ (বিআর১১-সাব১) রোপা আমন মৌসুমে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত আকস্মিক বন্যায় ডুবে থাকলেও হেক্টরে ৪-৪.৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
জীবনকাল:স্বাভাবিক বন্যামুক্ত পরিবেশে ১৪০-১৪৫ দিন এবং ১৪ দিনের আকস্মিক বন্যা কবলিত হলে ১৫৫-১৬০ দিন।
কৃপ্র/এম ইসলাম