কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহেষ রৌহালী গ্রামের বাসিন্দারা একসময় চরম অভাব-অনটনে জীবনযাপন করত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এ গ্রাম শহর থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছিল। কয়েক বছর ধরে এ গ্রামের মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে হারিকেন হ্যাচারি। এ পদ্ধতিতে হারিকেনের তাপ দিয়ে হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। এই হ্যাচারির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে তাড়াশ উপজেলার শতাধিক পরিবার। লাভজনক হওয়ায় আশপাশের উপজেলায়ও জনপ্রিয় হচ্ছে এই হারিকেন হ্যাচারি।
হারিকেন হ্যাচারিতে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন মহেষ রৌহালী গ্রামের শাহ আলম। তিনি বলেন, ২০০৪ সালের শেষ দিকে নিজ উদ্যোগে একটি হাঁসের খামার স্থাপন করি। এ খামারে প্রথমে দুই হাজার ডিম দিয়ে হারিকেন হ্যাচারি চালু করে ব্যবসা শুরু করি। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন হ্যাচারিতে প্রতি মাসে প্রায় দুই লাখ হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে। শাহ আলমকে দেখে আশপাশের আরো অনেকে হারিকেন হ্যাচারি স্থাপন করেন। লাভজনক হওয়ায় তাদের পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। হ্যাচারি ব্যবসায়ীরা জানান, এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত হাঁসের বাচ্চা আশপাশের জেলা, এমনকি ভারতেও সরবরাহ করা হয়।
তারা জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাঁসের ডিম সংগ্রহের পর সেগুলো পানিতে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। এর পর বাছাই করা ডিম মাটি বা ইটের তৈরি পাকা ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচায় সারিবদ্ধভাবে রেখে তোশক বা মোটা কাপড় দিয়ে দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। মাচার নিচে হারিকেন বসিয়ে পরিমাণমতো তাপ দেয়া হয়। ২৫ দিন পর ডিমগুলো ফুটতে শুরু করলে কাপড়ের আবরণ তুলে নেয়া হয়। ২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। প্রতিটি একদিন বয়সের হাঁসের বাচ্চা ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হয়। ডিমের দামের ওপর নির্ভর করে বাচ্চার দামও কমবেশি হয়ে থাকে।
রৌহালী গ্রামের হ্যাচারি ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা জানান, শাহ আলমকে দেখে এ ব্যবসা শুরু করি, এখন ভালো লাভ হচ্ছে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার আগেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে অর্ডার দিয়ে যায়। একই গ্রামের আব্দুল আজিজ বলেন, প্রথমে দেখে আমার কাছে এ পদ্ধতি কার্যকর নয় বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু নিজে হ্যাচারি দেয়ার পর সে ভুল ভেঙেছে। এখন হারিকেন হ্যাচারির মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদন করে সংসার চলছে। তিনি বলেন, পুঁজির অভাবে ব্যবসা প্রসার ঘটানো যাচ্ছে না। সহায়তা পেলে হ্যাচারির পরিধি বাড়িয়ে চাহিদা অনুযায়ী হাঁসের বাচ্চা ফুটানো সম্ভব।
স্থানীয়রা জানায়, শুষ্ক মৌসুমে হেঁটে আশপাশের গ্রামের মানুষ শহরে ও বাজারে যাতায়াত করত। বর্ষার সময় চলাচল করতে হতো নৌকা দিয়ে। এ কারণে সবসময় এখানে কাজের অভাব থাকত। তবে এ চিত্র পাল্টে দিয়েছে হারিকেন হ্যাচারি। কম পরিশ্রম ও লাভজনক হওয়ায় এখন অনেকেই এ ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। পাঁচ বছর আগে যারা এ ব্যবসা শুরু করেছিলেন, এখন তারা সচ্ছল। আশপাশের একশর বেশি পরিবার এখন হারিকেন হ্যাচারির মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদন করছে। নারীরাও সংসারের কাজের ফাঁকে এ পদ্ধতিতে বাচ্চা উৎপাদনে পরিবারের লোকদের সহায়তা করছেন।
মহেষ রৌহালী গ্রামের আদরী খাতুন বলেন, হারিকেন হ্যাচারি শুরুর পর থেকে এ গ্রামের লোকজনকে কাজের খোঁজে আর বাইরে যেতে হয় না। বরং অন্য গ্রামের লোকজন এখন এসব হ্যাচারিতে কাজ করছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান ভুইয়া জানান, হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন সম্ভাবনাময় খাত। দেশে চাহিদার তুলনায় হাঁসের বাচ্চার উৎপাদন কম। এ চাহিদা মেটাতে সরকারিভাবে ডাক হ্যাচারি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে আপাত চাহিদা মেটাচ্ছে হারিকেন হ্যাচারি। তিনি বলেন, স্বল্প পুঁজি ও পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় তাড়াশ ছাড়াও বেলকুচি, উল্লাপাড়াসহ জেলার অন্যান্য উপজেলাতেও হারিকেন হ্যাচারি প্রসার লাভ করছে। এ পদ্ধতি সঠিকভাবে ব্যবহার করে শতভাগ বাচ্চা উৎপাদনের জন্য জেলার প্রায় ৬০০ জনকে ভাতাসহ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম