‘ব-দ্বীপ এলাকার মাছ ও ফসল উৎপাদনে বন্যা কেবল ক্ষতিকর নয়, আশীর্বাদ হয়েও আসে’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ এপ্রিল মাসে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হাওরবাসীর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। ধানগাছ পচে পানিদূষণে মরে যায় প্রচুর পরিমাণে মাছ। তাই এখানকার জেলেদের জাল থাকে মাছশূন্য। তবে এই আগাম বন্যা মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। এ বছরের শেষেই এর সুফল মিলবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, হাওরে বন্যা মাছ উৎপাদনে আশীর্বাদ হতে পারে। আগাম এই বন্যায় মাছ উৎপাদন শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পেতে পারে। এ আশাবাদ প্রকাশ করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য হাওরে মানুষের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবেই মাছের উৎপাদন নিশ্চিত হবে। প্রতিবেদন প্রথম আলো।
প্রথম দিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, হাওরে মাছ মারা যায় ১ হাজার ২৭৬ মেট্রিক টন। পরে ২১৩ দশমিক ৯৫ মেট্রিক টন মাছ মারা যাওয়ার কারণ জানায় একই মন্ত্রণালয়। মাছ মারা যাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলের সংখ্যা ৭৪ হাজার ৬২৬ জন জেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাছ মারা যাওয়ার পরিমাণ কম-বেশি হলেও এটি ভবিষ্যৎ উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে না। বরং পচে যাওয়া ধানগাছ থেকে মাছের জন্য খাদ্য উপাদান পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের বলেন, ‘ব-দ্বীপ এলাকার মাছ ও ফসল উৎপাদনে বন্যা কেবল ক্ষতিকর নয়, আশীর্বাদ হয়েও আসে। বন্যার কারণে পলি বয়ে আনায় মাটির গুণগত মান বৃদ্ধি যায়। নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়সহ জলাশয়গুলোতে বন্যার কারণে পানির গুণগত মান ভালো হয়।
হাওরে এবার বড় ধরনের পানিদূষণ হলেও আগাম পানি আসায় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের। তিনি দূষণ হলেও হাওরে আগাম পানি আসায় মাছের চেয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ, হাওরে নানা রকমের মাছ থাকে। আগাম বৃষ্টিপাতের কারণে পানির গুণাগুণ ভালোর দিকে যেতে থাকলে এ মৌসুমে হাওরের মাছগুলোর তাড়াতাড়ি ডিম পাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পানিতে থাকা প্লাঙ্কটন ছাড়াও জলজ গাছ এবং আগাছার গায়ে মাছের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাবার পেরিফাইটনের উৎপাদন মাছের শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
পানির বিষক্রিয়া পরীক্ষা করে বড় আকারের মাছের পোনা ছাড়লে মুক্ত জলাশয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এতে করে বর্তমান ক্ষতি অনেকখানি পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে বলে জানান তিনি।
এবারের বন্যার ফলে ধানগাছ মরে অনেক মা মাছ মারা গেছে। এটি মাছের বংশবৃদ্ধিতে একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। এবার মাছের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি সামাজিক চাপও কাজ করবে বলে মনে করেন তিনি। তা হলো ফসল হারানো মানুষ মাছের আহরণ বেশি পরিমাণে করতে পারে। আবার এ অবস্থায় সরকারও হয়তো কঠোর হবে না। তবে অধ্যাপক মাহফুজুল হক বলেন, এসব পরিস্থিতি যদি সামাল দেওয়া যায়, তবে হাওরে মাছের উৎপাদন বাড়তে পারে।
মৎস্য অধিদপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, সিলেট বিভাগে সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর এলাকাজুড়ে রয়েছে হাওর। এ সব এলাকায় প্রায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। দেশের প্রায় আড়াইশ প্রজাতির দেশি মাছের মধ্যে ২০০ প্রজাতির মাছ হাওর অঞ্চলে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৩ বিপন্ন প্রজাতির মাছের দেখা মেলে হাওরগুলোতে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে বার্ষিক মাছ উৎপাদন হয় ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে হাওরগুলো থেকে পাওয়া গেছে প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন মাছ। প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ও প্রকৃতি থেকে উৎপাদিত খাবার খায় হাওরের মাছ। তাই এসব মাছ চাষের মাছের চেয়ে তুলনামূলক সুস্বাদু। একই প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছের আবাসস্থল এই হাওর অঞ্চল। এর মধ্যে ঘোড়ামুখী, আগুনচোখা, ঘড়িয়াসহ আট ধরনের রুই মাছ। সরপুঁটি, কাঁঠালে পুঁটি, তিতপুঁটি, বাঘাপুঁটি, মেনাপুঁটি, জাতপুঁটি, গিলিপুঁটি, টেরিপুঁটি তো আছেই। মহাশোল, বাগাড়, ট্যাংরা, বুজুরি, রানি ট্যাংরা, গুলসা, গাঙ ট্যাংরা, আইড়, কই, নাপতে কইয়ের মতো হারিয়ে যাওয়া মাছের আবাসস্থল এখন হাওর।
এবার হাওরে পানিদূষণে সব ধরনের মাছ মরে ভেসে উঠতে দেখা গেছে। এ কারণে ১৭ এপ্রিল মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কয়েকটি হাওর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের সময় হাওরের পানি পরীক্ষা করে দেখা যায়, পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ১ থেকে শূন্য দশমিক ৮ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), যা স্বাভাবিক মাত্রার (৫ থেকে ৮ পিপিএম) চেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কম। একই সঙ্গে অ্যামোনিয়ার পরিমাণও ছিল শূন্য দশমিক ৪ থেকে শূন্য দশমিক ৬ পিপিএম, যা অস্বাভাবিক। অ্যামোনিয়ার লিথাল মাত্রা পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ২ পিপিএম। দেশের অন্যান্য হাওরেও একই সময়ে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৫ পিপিএম এবং অ্যামোনিয়ার পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ থেকে শূন্য দশমিক ৮ পিপিএম পাওয়া গেছে। পিএইচের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক শূন্য থেকে ৬ দশমিক শূন্য পর্যন্ত, যা সহনীয় পর্যায়ের (৬.৫ থেকে ৮.৫) নিচে ছিল।
তবে এপ্রিল মাসের শেষ দিকের টানা বৃষ্টিতে হাওরের পানিতে দূষণ কমে গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মুস্তাফিজুর রহমান জানান, পিএইচের মাত্রা এখন ৭ দশমিক ৫। মাছের প্রজনন শুরু হয়ে গেছে। পচে যাওয়া ধানগাছ থেকে গ্লুকোজ কনভার্টেড হয়ে মাছের খাবার তৈরি হবে। হাওরে পোনা ছাড়া হলে প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে মাছ সহজেই বড় হওয়ার সুযোগ পাবে। আগাম বৃষ্টির কারণে অক্টোবর পর্যন্ত মাছ বড় হতে পারবে। শীতের আগে হাওরে পানি কমে গেলে এর সুফল পাওয়া যাবে। মুস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, বিল নার্সারি স্থাপন এবং জেলেদের এক মাস বিনা মূল্যে চাল দেওয়ার কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বাড়তে পারে।
কৃপ্র/এম ইসলাম