কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ দিনাজপুরে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার অটো রাইস মিল ও সেমি অটো রাইস মিল। প্রতি বছরই এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মিল মালিকদের ব্যবসার পরিধিও। কিন্তু বরাবরের মতোই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে এসব মিলের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি। গত তিন দশকে মিল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে শতাধিক শ্রমিকের।দিনাজপুর চাতাল ও চালকল শ্রমিক সংগঠন এবং কল-কারখানা পরিদর্শন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় আড়াই হাজারের বেশি অটো রাইস মিল ও হাসকিং মিল রয়েছে। এর মধ্যে অটো রাইস মিল রয়েছে ১৫০টি, সেমি অটো রাইস মিল ৭৫টি এবং হাসকিং মিল ও চাতালের সংখ্য প্রায় ২ হাজার ৩০০টি। ১৯৯০ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক। এছাড়া এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আরো কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। আহত শ্রমিকদের অনেকেই এখন বিভীষিকাময় জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা অটো রাইস মিল ও হাসকিং মিলে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ও আহত হয়েছেন অনেক শ্রমিক। এর মধ্যে দিনাজপুর সদরের পুলহাট এলাকার আব্দুল গফুর রাইস মিল, তাহের রাইস মিল, অঞ্জলী রাইস, রিংকু রিপন রাইস মিল, তৌহিদ অটোমিল, বোচাগঞ্জের সালাম অটো রাইস মিলের বয়লার বিস্ফোরণে ১৮ জনসহ সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল সদরের চেহেলগাজী ইউনিয়নের যমুনা অটো রাইস মিলে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আরো সাত শ্রমিক। শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে না নেয়ায় একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
চাতাল শ্রমিক সহায়তা কমিটির নেতা রবিউল আউয়াল খোকা ও শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দিনাজপুর জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে তোলা দেড় শতাধিক অটো রাইস মিলের মধ্যে বেশির ভাগেই রয়েছে অকেজো ত্রুটিপূর্ণ সেফটি ভালভ। দীর্ঘদিন ধরে মেরামত না করায় অধিকাংশ অটো ও হাসকিং মিলে লাগানো ভালভ অকেজো হয়ে পড়েছে। সেফটি ভালভ অকেজো থাকা সত্ত্বেও মিল মালিকরা মিল বন্ধ না করেই শ্রমিকদের দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। আর এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের। এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জানানো হলেও সমাধানে সুষুম কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।’
তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘জেলা প্রশাসন কিংবা কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা কখনো মিলগুলো পরিদর্শন করেন না, যে কারণে অহরহ দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ শ্রমিকদের। এ ব্যবসা থেকে মিল মালিকরা আর্থিকভাবে উন্নয়ন করলেও শ্রমিকের ভাগ্যে জুটছে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ববরণ।’ তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘মিলগুলোয় সরকার ঘোষিত শ্রম আইন মানা হয় না এবং পরিদর্শনের জন্য নেই সুব্যবস্থা। এখানে সরকারের দপ্তর ও কর্মকর্তা থাকলেও তারা কখনো নিয়ম অনুযায়ী রুটিন ওয়ার্ক করেন না।’
সম্প্রতি যমুনা অটো রাইসমিলের বয়লার বিস্ফোরণে আহত আনিসুর আলীর ছেলে মো. কামিয়াব হাসান সজল জানান, বর্তমানে তার বাবা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিত্সাধীন। গত কয়েক দিনের চিকিত্সায় তার শারীরিক অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে চিকিত্সকরা জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ ভালো হতে আরো সময় লাগবে। তিনি আরো জানান, তার বাবা ভালো হয়ে আদৌ কাজে ফিরতে পারবেন কিনা, তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বর্তমানেই তাদের সংসার কীভাবে চলবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। একই ঘটনায় আহত শ্রমিক উত্তর ভবানীপুর গ্রামের জহির মোহাম্মদের পুত্র মো. বাদল আলী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিত্সাধীন রয়েছেন।
এদিকে ২০১০ সালে সদরের বটতলী এলাকার অঞ্জলী রাইস মিলের বয়লার বিস্ফোরণে আহত উত্তর গোঁসাইপুর গ্রামের আজিজুল ইসলামের স্ত্রী বকুল বেগম জানান, বয়লার বিস্ফোরণে আহত হয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকলেও তার খবর কেউ রাখে না। ডান হাতের আঙুল জোড়া লাগা অবস্থায় পঙ্গুত্বের মাঝে বর্তমানে দুই সন্তানকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছেন।
তিনি জানান, ঘটনার দিন তাকে মিলের মালিকরা চিকিত্সার জন্য ঢাকায় নিয়ে গেলেও মাসখানেক চিকিত্সা খরচ চালানোর পরে আর কখনো খবর নেননি। এখন তাকে মানুষের কাছে হাত পেতে চলতে হচ্ছে। এভাবে যেন আর কোনো শ্রমিককে অসহায় হতে না হয়— এটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।দিনাজপুর কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মেহেদী হাসান বলেন, ‘জেলায় মোট ৫০২টি রেজিস্ট্রেশনকৃত রাইস মিল রয়েছে। ২০১৪ সালে এ জেলায় অফিস স্থাপন করা হয়েছে তাই এর আগের ঘটা দুর্ঘটনার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ অটো রাইস মিলগুলো পরিদর্শনে অনিয়ম করা হচ্ছে কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এর বাইরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ঘটতে পারে।’
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম