কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক।।
এক সময় লঞ্চ কলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার শিবুপদ রায় (৫৮)। এখন তিনি সফল সবজি ও মৎস্যচাষি হিসেবে এলাকায় পরিচিত। গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সমন্বিত কৃষি খামার। ২৬৭ একর জমিতে আবাদ করেছেন বিভিন্ন ধরনের সবজি। সমন্বিত এ খামার থেকে বছরে উৎপাদিত হয় কোটি টাকার উপরে মাছ, সবজি, ধানসহ বিভিন্ন ধরণের কৃষিপণ্য।
শিবুপদ রায় জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তার বাবাকে হত্যা করে। তখন শিবুপদের বয়স মাত্র ১১ বছর ৮ মাস। পিতৃহীন সংসারে মা ও দুই বোনকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন তিনি। লঞ্চে করে নড়াইলের কালিয়া থেকে বড়দিয়া এবং খুলনার দৌলতপুর পর্যন্ত কলা বিক্রি করতেন শিবুপদ। লঞ্চে কলা বিক্রির সময় একদিন দেখা হয় নড়াইলের বড়দিয়ার ভুষিমাল ব্যবসায়ী নিত্যানন্দ সাহার সাথে। পরবর্তীতে ব্যবসায়ী নিত্যানন্দ সাহার দোকানে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে কর্মচারী হিসেবে কাজ করা শুরু করি। দোকানে কাজ করেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করি। বেতনের ১৬ হাজার ৬০০ টাকা জমিয়ে ১৯৭৮ সালে কালিয়া পৌর এলাকায় ভুষিমালের দোকান দেই।
জানা যায়, জীবন সংগ্রামের পথ ধরে ১৯৮৮ সালে ১০ একর জমি ইজারা (লিজ) নিয়ে বাড়ির পাশের চিংড়িমাছের চাষাবাদ শুরু করেন তিনি। তখন থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি শিবুপদ রায়ের। ঘেরের পাশাপাশি রাইচমিল বসিয়ে ধানছাটাই শুরু করেন। ২০১৫ সাল থেকে বড় আকারে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলেন শিবুপদ। প্রথমে ২২৬ একরে এবং পরবর্তীতে ২৬৭ একর জমিতে চাষাবাদ করে আসছেন সবজি, ধানসহ চিংড়ি ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে এ বছর ১০০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ করেছেন। ২৬৭ একর জমি ৫০০ জনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন তিনি। ২০ বছর চুক্তিতে ইজারা নেয়া এসব জমির মালিকদের একরপ্রতি বছরে দিতে হয় সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। আর শিবুপদ রায়ের নিজের বলতে মাঠে ১০ একর এবং বসতবাড়িতে চার একর জমি আছে। এখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিষ ও ফরমালিনমুক্ত বলে জানান তিনি।
সমন্বিত কৃষি খামারের উদ্যোক্তা শিবুপদ রায় বলেন, আমার কৃষি খামারে টমেটো, কুমড়া, পেঁপে, করলাসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির আবাদ করি। পাশাপাশি ২৬৭ একরের বিশাল ঘেরে চিংড়ি ও বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ চাষাবাদ করা হয়। এছাড়া আমন ও বোরো মওসুমে ধানের আবাদও করা হচ্ছে। এসব কৃষি পণ্য যশোর, গোপালগঞ্জ, মাগুরা নড়াইল, ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এই কৃষি খামার থেকে বছরে কোটি টাকার উপরে কৃষিপণ্য ও মাছ বিক্রি করা হয়। শ্রমিক ও পণ্য পরিবহন খরচ এবং ইজারা নেয়া জমির মালিকদের টাকা পরিশোধের পর শিবুপদ রায়ের বছরে লাভ থাকে প্রায় ৪০ লাখ টাকা।
কালিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাজিব রায় জানান, এ ঘেরে গলদা চিংড়ি, রুই, কাতলা, গ্লাসকাপ, মিনারকাপ, তেলাপিয়া, পুঁটিসহ বিভিন্ন মাছের চাষ হয়। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন তিন থেকে চার মণ চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ ১০ থেকে ২৫ মণ বিক্রি করা হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ মাছ ঢাকাসহ আশপাশের জেলার মৎস্য ব্যবসায়ীরা কিনে নেন।
কালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুবির কুমার বিশ^াস জানান, শিবুপদ রায়ের খামারের শাক-সবজি বিষ ও ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা বেশি। এখানে ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ৫০ মণ টমেটো তোলা হয়। এছাড়া প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ মণ পেঁপে ও এক হাজার পিস লাউ এবং প্রতি মৌসুমে এক হাজার মণ মিষ্টি কুমড়া, দুই থেকে আড়াই হাজার মণ শশা ও করলা বিক্রি করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নড়াইলের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ চিন্ময় রায় বলেন, ২৬৭ একরের এ বহুমুখী ক্ষেতটি নয়নাভিরাম ও দৃষ্টিনন্দন। পাশাপাশি এটি অত্যন্ত লাভজনক। এ ধরনের কৃষি খামার অন্যদেরও অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।
তথ্য সুত্র, বাসস /সোনালীনিউজ/ কৃপ্র/এম ইসলাম