আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ: ১৮৪৬ সালে ইউরোপে সংগঠিত আইরিশ ফেমিন এর কথা আমরা সবাই জানি। আলুর লেট ব্লাইট রোগের কারনে ফসলহানী ঘটায় ঐ দূর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা দাড়িয়েছিল প্রায় দশ লক্ষে, আরো পনের লক্ষ মানুষ বাঁচার তাগিদে স্থানান্তরিত হয়েছিল। মূলতঃ গম ছিল ইউরোপের প্রধান ফসল। কিন্তু গমে ভয়াবহ রাষ্ট রোগের কারনে উত্তর আমেরিকার থেকে আগত ফসল আলু ইউরোপে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এবং প্রধান খাদ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়। লেট ব্লাইট রোগের জীবাণুও উত্তর আমেরিকা থেকে আলুর সাথে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করে। পশ্চিম ইউরোপের আবহাওয়া উক্ত রোগের জন্য অনূকুল হওয়ায় মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগটি মহামারি আকারে দেখা দেয়। ফলে সভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যায় এক ভয়াবহ বিপর্যয়।
তেমনি আরেকটি ঘটনা ঘটে ফ্রান্সে। সেখানে শিল্পায়ন এর সময় ওয়াইন কারখানার ব্যাপক প্রসার ঘটে যার মূল উপকরন ছিল আঙ্গুর। একসময় সেখানকার আঙ্গুর বাগানগুলোতে এফিড বা জাব পোকার আক্রমন দেখা দেয় এবং অধিকাংশ বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। বিপর্যয় নেমে আসে শিল্প কারখানায়। তখন তারা বাধ্য হয়েই উত্তর আমেরিকা থেকে এফিড প্রতিরোধী আঙ্গুরের জাত এনে চাষাবাদ শুরু করে। কিছুদিন পর সেখানে আবির্ভূত হলো এক নতুন এক সমস্যা। বাগানগুলোতে এফিডের আক্রমন নেই, কিন্তু দেখা দেয় এক ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাব। ১৮৭০ সালে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডাউনি মিলডিও রোগে অধিকাংশ আঙ্গুর বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে আবারো বিপর্যয় দেখা দেয় শিল্প কারখানায়। এফিড প্রতিরোধী আঙ্গুরের জাতের সাথে ডাউনি মিলডিও রোগের জীবাণু উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করে। তখন মহামারির কারনে ফলন ব্যহত হওয়ায় শিল্পকারখানাগুলো পড়ে এক মহাসংকটে। অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়ে, দেখা দেয় সামাজিক বিপর্যয়।
একবিংশ শতাব্দিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূত উন্নতির কারনে প্রতিনিয়ত একদেশের ফল-ফসল, গাছ-পালা, বীজ, চারা খুব দ্রুত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করছে। এসব ফল-ফসল, গাছ-পালা, বীজ একদেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় বহন করে আনছে বিভিন্ন নিত্য নতুন ক্ষতিকর রোগজীবানু, পোকামাকড় কিংবা আগাছা। ফলে কোন এলাকার কৃষি, জীববৈচিত্র ও ফল-ফসল পড়ছে এক ভয়াবহ হুমকীর মুখে।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের খুলনা বিভাগের বেশ কয়েকটি জেলায় গমের জমিতে অতি ক্ষতিকর ব্লাস্ট নামক একটি নতুন ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দিয়েছে, যার আক্রমনে উক্ত এলাকার অধিকাংশ ফসল বিনষ্ট হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে এ রোগটি সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা দেয় । এরপর এটি দক্ষিন আমেরিকার কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিন আমেরিকার বাহিরে বাংলাদেশেই এ ভয়াবহ রোগটি সর্বপ্রথম সংক্রমিত হলো।
এ রোগের জীবাণু বীজ ও বাতাস বাহিত। এ রোগের জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে আমাদের দেশে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং বীজ কিংবা খাদ্যশস্যের মাধ্যমে রোগের জীবাণু দেশে প্রবেশ করে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রতিয়মান হয়, বাংলাদেশে সংক্রমিত ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক ব্রাজিলে বিদ্যমান ছত্রাকের অনুরূপ। উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার্যক্রমের দূর্বলতার কারনে গমের এই ভয়ংকর রোগটি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদদের ধারনা। গমের ব্লাস্ট রোগটি এতটাই ভয়াবহ যে, কোন বালাইনাশক দিয়ে একে দমন করা সম্ভব হয়না। এমনকি এ রোগের কোন প্রতিরোধক জাতও এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। সাধারনত কোন এলাকায় আক্রমন দেখা দিলে প্রায় শতভাগ ফসল বিনষ্ট হয়।
গত বেশ কয়েকবছর ধরে সারাদেশে জায়ান্ট মিলিবাগ এর আক্রমন সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত এবং আতংকিত। ফল-ফসল ও উদ্ভিদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এ পোকাটিও আমাদের দেশের নয়। আফ্রিকায় এ পোকাটির উৎপত্তি হলেও গত কয়েক দশক ধরে এটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কারো কারো মতে বাংলাদেশে এ পোকাটি এসেছে আফ্রিকা অথবা ভারত কিংবা পাকিস্থান থেকে। এই ক্ষতিকর পোকাটির দেহের বাহিরে কীটনাশক প্রতিরোধী মোমের আবরন থাকায় কোন কীটনাশক দিয়ে একে মারা যায় না। আবার বছরের অধিকাংশ সময় পোকাসমূহ মাটির নিচে থাকায় এদের সহজে দমন করা যায়না। দেশের বাহির থেকে আসা বেশ বড় আকারের পাখাবিহীন এ পোকটি অতি অল্পসময়ে যেভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে ভবিষ্যতে এর আক্রমনে ভয়াবহ ফসলহানী ও বিপর্যয়ের আশংকা থেকেই যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে পার্থেনিয়াম নামক অতি ক্ষতিকর আগাছার উপদ্রব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই আগাছার উপস্থিতি ফসল, গবাদীপশু ও মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি একদিকে যেমন ফসলের ক্ষতি করে থাকে, তেমনি আবার গবাদীপশু ও মানবদেহে স্বাসনালীর এলার্জি সৃষ্টি করে থাকে। অতি মাত্রায় এলিলোপ্যাথিক ক্রীয়া’র কারনে এই আগাছাটি ফসলের জমিতে মারাতœক ফসলহানী ঘটায়। আবার এটি সহজে দমনও করা যায়না। একক পদ্ধতিতে দমন করা যায়না বিধায় একে নিয়ন্ত্রনে রাখাও বেশ ব্যায়বহুল ও কষ্টসাধ্য। এই আগাছাটিকে বিশ্বে ফসল ও জৈববৈচিত্রের জন্য বড় হুমকী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেহেতু সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে এই আগাছার আক্রমন প্রথম দেখা দেয়, তাই ধারনা করা হয় পাশ্ববর্তী দেশ থেকে বাংলাদেশে এই আগাছার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অনুপ্রবেশকৃত রোগজীবানু, পোকামাকড় কিংবা আগাছা’র মধ্যে উপরোক্ত তিনটিকে সর্বাধিক ক্ষতিকর এবং দেশের আগামীর কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনে হুমকী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও বর্তমানে দেশে ফসলের জমিতে বেশ কয়েক ধরনের ক্ষতিকর শামুকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেগুলোর সাথে আফ্রিকার শামুকের মিল রয়েছে। এগুলোও ফসলের জন্য ক্ষতিকর।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, ধানের টুংরো ভাইরাস ফিলিপাইন থেকে ষাটের দশকে আমাদের দেশে প্রবেশ করে আইআর ৮ ধানের মাধ্যমে। ধানের ব্লাস্ট রোগের জীবাণু আসে ফিলিপাইন থেকে আনা ইরি ধানের মাধ্যমে, কলা গাছের বাঞ্চি টপ ভাইরাস আসে শ্রীলংকা থেকে আসা সাকার বা চারার মাধ্যমে, আলুর লেট ব্লাইট বা নাবী ধ্বসা রোগ আসে হলান্ড থেকে বীজ আলুর মাধ্যমে। উপরোক্ত রোগসমূহ বর্তমানে বাংলাদেশের ফসলের প্রধান রোগ হিসেবে বিবেচিত। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফল-ফসলের সাথে দেশে অনুপ্রবেশ করছে নতুন নতুন পোকামাকড়, রোগবালাই ও আগাছা। এ ধরনের অনাকাংখিত পোকামাকড় ও রোগজীবানুর অনুপ্রবেশ মোকাবেলার জন্য প্রতিটি দেশেই রয়েছে সুনিদিষ্ট কিছু আইন কানুন।
অনুমোদনহীন উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদি আমদানি-রফতানির জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান করে গত ২০১১ সালের ২০ মার্চ সংসদে ‘উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বিল- ২০১১’ পাস হয়। বিলটির উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদির আন্তর্জাতিক পরিবহনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পোকা-মাকড়, রোগবালাই অনুপ্রবেশ ও বিস্তার রোধ এবং উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক ও সহায়ক ব্যবস্থাদির উদ্দেশ্যে ‘উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইন-২০১১’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
নতুন প্রণীত এ উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইনে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার্যক্রম নিয়ে আটটি এবং অপরাধ ও দন্ডসংক্রান্ত ৯টি ধারা রয়েছে। আইনের ২৬ ধারা (সরকারি অনুমোদন ছাড়াই আমদানি, প্যাকেটজাত ও বিপণন) অমান্য কররে দুই বছরের কারাদন্ডসহ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও দেয়া হবে বিশেষ ক্ষমতা। আইনটি পাশের সময় মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে উল্লেখ করেন, নতুন আইনের প্রয়োগ হলে ফসল, খাদ্যদ্রব্য এবং জনস্বাস্থ্য হবে আরো সুরক্ষিত। সময়ের প্রয়োজনেই আইনটির প্রয়োগ মাঠপর্যায়ে দ্রুত কার্যকর করা হবে।
এই আইনের মাধ্যমে জাতীয় উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই কর্তৃপক্ষ অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে সঙ্গনিরোধ বালাইয়ের অনুপ্রবেশ রোধের লক্ষ্যে উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদি, উপকারী জীবাণু ও প্যাকিং দ্রব্যাদির আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রণসহ ২১টি দায়িত্ব পালন করবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তাকে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করতে পারবে। উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদি আমদানি রফতানি করা যাবে না। এ ছাড়া নিষিদ্ধ দ্রব্য থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ ও মুনাফা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
উক্ত আইন বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের সকল সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, নদীবন্দর ও স্থলবন্দরসমূহে প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন সেন্টার রয়েছে। যেখান থেকে উদ্ভিদজাত দ্রবাদি আমদানী ও রপ্তানীর জন্য ছাড়পত্র (ফাইটোস্যানিটারী সার্টিফিকেট) প্রদান করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো উক্ত কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলোতে দক্ষ জনবল ও গবেষণাগারের অপ্রতুলতা প্রকট। উপরন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ ফসলের ‘পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস’ না থাকায় যথাযথ নিয়মে ছাড়পত্র ইস্যু করা যাচ্ছে না। একই কারনে ফল-ফসলের রপ্তানী কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। আবার আমদানীও থেকে যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ন।
আমাদের দেশে আইনের বাস্তব প্রয়োগ না থাকলে ইউরোপসহ উন্নত দেশসমূহ এ ব্যাপারে বেশ সচেতন। বছর কয়েক আগে তাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর জীবাণুর উপস্থিতি থাকায় বাংলাদেশ থেকে তারা লেবু ও পান আমদানী নিষিদ্ধ করে। অতি সম্প্রতি ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি থাকায় ইউরোপের বাজারে ভারতীয় আম নিষিদ্ধ করা হয়। উন্নত দেশসমূহ ফল-ফসলের মাধ্যমে অনাকাংখিত রোগজীবানু, পোকামাকড় কিংবা আগাছা অনুপ্রবেশ বিষয়ে বেশ সতর্ক। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এবিষয়ে তারা কোনপ্রকার ছাড় দিতে রাজী নয়।
বাংলাদেশ- পৃথিবীর অতি ঘনবসতিপূর্ন দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম। প্রায় সকল মানুষের একই ধরনের খাদ্যের উপর নির্ভরশীলতা এবং দেশব্যাপি সম ধরনের আবহাওয়া বিরাজমান থাকায় যেকোন সময় কোন একটি ক্ষতিকর পোকামাকড় কিংবা রোগবালাই এর আক্রমন ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সংকটে ফেলতে পারে আমাদের ফসল, জীববৈচিত্র, বাস্তুসংস্থান ও প্রকৃতিকে। তাই আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে এখনই। কোন প্রকার অনাকাংখিত পোকামাকড়, রোগবালাই, আগাছা যাতে দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইনের বাস্তব প্রয়োগ অপরিহার্য ।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।