কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে ‘কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ভাসমান পদ্ধতির সবজি চাষ। বহু বছর ধরে নিজেদের উদ্ভাবিত ‘ধাপ’ পদ্ধতিতে চাষ করে আসছে বৃহত্তর বরিশালের নিচু এলাকা ও বাংলাদেশের হাওর এলাকার চাষিরা। বৃহত্তর বরিশালের কয়েকটি নিচু এলাকা ঘুরে এসে জানালেন রফিকুল ইসলাম।
যে দিকে চোখ যায় বিল আর বিল। একসময় সেগুলো কচুরিপনা, দুলালী বন, শ্যাওলা ও ফ্যানা ঘাসসহ অনেক জলজ উদ্ভিদে ঠাসা থাকত। তাই বলে চাষ হবে না! এসব জলজ উদ্ভিদকেই কাজে লাগালেন কৃষকরা। বের করলেন নতুন পদ্ধতি। সেগুলো স্ত‚প করে পচিয়ে তৈরি করলেন পানিতে ভেসে থাকতে পারে এমন ধাপ। এই ধাপের ওপরেই হবে চাষ। অনেক বছর ধরেই বরিশালের অনেক নিচু এলাকায় ধাপ পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। এমন চাষ হচ্ছে অনেক হাওর এলাকায়ও। নিচু এলাকাগুলোর হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকার কথা। কিন্তু সেখানে এখন ভাসমান আবাদের সমারোহ। কৃষকদের জীবনের এসেছে সচ্ছলতা, মুখে ফুটেছে হাসি।
পিরোজপুরের নাজিরপুর আর স্বরূপকাঠী উপজেলার নিচু এলাকা দেউলবাড়ি দোবড়া, মালিখালী ও দীর্ঘা ইউনিয়নের মুগারঝোর, কলারদোয়ানিয়া, দীর্ঘা, বৈঠাকাঠা, খলনি, মেদা, সাচিয়া, পাকুরিয়া, গাঁওখালী, পদ্মডুবি, বিল ডুমুরিয়াসহ অনেক গ্রামের পতিত জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে শাকসবজি ও তরকারির চারা উৎপাদন ও চাষাবাদ হচ্ছে। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দির উমরেরপাড়, আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সারহাট এলাকায় এ পদ্ধতিতে সবজি চারা উৎপাদন করা হয়। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ ও শরীয়তপুর জেলার নিচু এলাকাগুলোতেও ধাপ পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি সুনামগঞ্জের হাওর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাদারীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মানিকগঞ্জ ও সুনামগঞ্জকেও চাষের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ভাসমান পদ্ধতিতে লালশাক, পুঁইশাক, লাউ, কুমড়া, পেঁপে, বেগুন, বাঁধাকপি, করলা, ঝিঙা, শিম, বরবটি, টমেটো ও শসার চাষ হচ্ছে।
কথা হলো মুগারঝোর কৃষি উন্নয়ন সমিতির সভাপতি আক্তার হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, পণ্য পরিবহনের জন্য উন্নত ব্যবস্থা চালুসহ এলাকায় একটি হিমাগার স্থাপনের দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) একটি বীজ বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। পাশাপাশি এখানে কচুরিপানা সংকটের কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। তাই এ এলাকায় কচুরিপানা চাষাবাদ করার কৌশল উদ্ভাবন প্রয়োজন। কৃষি বিভাগ থেকে একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সাধারণ চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁরা এখন পর্যন্ত সমাধানের পথ খুঁজে দেননি।
১১ জেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল কৃষি অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুল হকের ভাষ্য, ‘কৃষি জমির বিকল্প হিসেবে জলাশয়ে চাষের এ পদ্ধতি কয়েক দশক ধরেই দেশের গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও বরিশালে সাফল্যের সঙ্গে চলে আসছে। এ পদ্ধতিতে কৃষির উৎপাদনশীলতা কৃষিজমির চেয়ে ১০ গুণ। এ ছাড়া সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চাষ হয়, রাসায়নিক সার ব্যবহার হয় না। ফলে উৎপাদন খরচও অর্ধেক। দেশের এ প্রযুক্তি নিয়ে জাপান, থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে গবেষণা চলছে। এর মাধ্যমে চাষের নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে তারা।’
দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে মজিবুল হক জানান, দেশে ভাসমান সবজি আবাদ সম্প্রসারণের জন্য কাপ্তাই হ্রদকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলায় যেখানে জলাবদ্ধতা বা পর্যাপ্ত পানি আছে, সেখানে সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে শাকসবজির পাশাপাশি আদা, মরিচ ও হলুদ চাষের নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন ফসল চাষও এর আওতায় নিয়ে আসা হবে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোস্তফা জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। ভাসমান চাষপদ্ধতি দিয়ে এর মোকাবিলা সম্ভব। তা ছাড়া বন্যাপ্রবণ এলাকায় এ পদ্ধতির ব্যবহার ছড়িয়ে দিলে দরিদ্র জনগণের খাদ্যের জোগান ও আয়ের উৎস হতে পারে। তেমনিভাবে বর্ষাকালেও এ পদ্ধতিতে সবজির চাহিদা মেটানো সম্ভব।
ধাপ পদ্ধতি
জলাভূমিতে প্রথমে কচুরিপানা, শ্যাওলা ও দুলালীলতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। এগুলো পচতে কয়েক দিন লাগে। একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০-৬০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার চওড়া হয়। ধাপে সরাসরি বীজ বপন করা যায় না। তাই কৃষকরা প্রতিটি বীজের জন্য এক ধরনের আধার তৈরি করেন। তারা এর নাম দিয়েছেন ‘দৌল্লা’। এক মুঠো করে টেপাপানা (ছোট কচুরিপানা), দুলালীলতার মধ্যে নারিকেল ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় দৌল্লা। শুধু নারীরাই ‘দৌল্লা’ তৈরির কাজ করেন। দৌল্লার মধ্যে বিভিন্ন সবজির অঙ্কুরিত বীজ পুঁতে মাচানে বা শুকনো জায়গায় রাখা হয়। এর আগে ভেজা জায়গায় বীজ অঙ্কুরিত করা হয়। দৌল্লাগুলো এভাবে তিন থেকে সাত দিন সারি করে রাখা হয়। এরপর ধাপে নিয়ে বসানো হয়। পাঁচ-ছয় দিন পর পর ধাপের নিচের কচুরিপানার মূল বা শ্যাওলা দৌল্লার গোড়ায় বিছিয়ে দেওয়া হয়। একটি অঙ্কুর বীজতলায় রোপণ করার ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক চারা হয়ে ওঠে। ৫০-৬০ মিটারের একটি ধাপ তৈরিতে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা লাগে।
বিশ্ব কৃষির ঐতিহ্যের অংশ
ভাসমান এ কৃষিবিপ্লব এখন বিশ্ব কৃষির ঐতিহ্যের অংশ হতে যাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে সবজি আবাদকে সম্ভাবনাময় গ্লোবালি ইমপর্ট্যান্ট এগ্রিকালচারাল হেরিটেজ সিস্টেম (জিআইএএইচএস) সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি আবাদকে চ‚ড়ান্ত স্বীকৃতির বিষয়ে এ বছর কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এফএও প্রতিনিধিদের আলোচনা হয়েছে। সেখানে চ‚ড়ান্ত স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করেন এফএও প্রতিনিধিরা। অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়। এফএও সাইটে বলা হয়, স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ভাসমান সবজি চাষে গবেষণা ও উন্নয়ন বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে জলাশয়ে স্থানীয়ভাবে ফসল উৎপাদনে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তথ্যবিনিময় ঘটবে। জিআইএএইচএস সাইটে দেখা গেছে, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ঐতিহ্য হিসেবে ভাসমান সবজি আবাদে ইতিমধ্যে চীন, জাপান, ভারত, কোরিয়া, আলজেরিয়া, চিলি, ইরান, কেনিয়া, মরক্কো, পেরু, ফিলিপাইন ও তিউনিসিয়া স্থান করে নিয়েছে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম