কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ।।
বাংলাদেশের মানুষ আগে অর্ধাহারে অনাহারে থাকত। এখন মানুষের ক্ষুধামুক্ত হয়েছে। মানুষ অপুষ্টিতে ভুগত, এখন কমেছে। জমি কমছে মানুষ বাড়ছে। তবুও কৃষি উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে আছে। তাদের ক্ষুধামুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশকে ক্ষুধামুক্ত করে বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ কাজ করছে। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করছে।
বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ বিরাট ভূমিকা রাখছে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ। বিদেশে এখন চাল রপ্তানি করছে। এবার দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন। আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর আলু রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয়। বছরে মোট সবজি উৎপাদন ১ কোটি ৬০ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিবছরই সবজির উৎপাদন বাড়ছে ৮-৯ শতাংশ ও ভুট্টার ১২-১৩ শতাংশ। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলেছে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী পাঁচ বছরে চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। শাকসবজির উৎপাদন বেড়েছে ৩২ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। তেল, ডাল ও মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৫০ হাজার, ২ লাখ ৪ হাজার ও ১ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন।
দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটির বেশি ফসল চাষ হচ্ছে। চারটি ফসল চাষ করার গবেষণা শেষ করে প্রক্রিয়া চলছে। পাঁচ ফসল মডেল চাষ করার জন্য কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি হয়েছে। ফসলের প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ১৭৯টি দেশে। এ পর্যন্ত ধানের ১০৭টি ও বিভিন্ন ফসলের প্রায় পাঁচ শতাধিক উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও ছয় শতাধিক বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
মাছ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রেও উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। দেশে এখন কৃষিতে কৃত্রিম উপগ্রহ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ওয়েবসাইট সহ বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। ১৯৭১ সনে আবাদি জমির ১৫ শতাংশ সেচের আওতায় ছিল এখন তা বেড়ে ৬১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এগুলো বিশ্বে ক্ষুধামুক্ত তথা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে ভূমিকা রাখছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে- সব মানুষের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদার বিপরীতে পছন্দ মতো পর্যাপ্ত নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তির বাস্তব ও আর্থিক ক্ষমতা থাকা। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জিত হয়েছে কিনা বোঝার উপায় হচ্ছে- জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ থাকবে, সময় ও অঞ্চলভেদে সরবরাহ স্থিতিশীল থাকবে, সবাই খাদ্য ক্রয় বা সংগ্রহ করতে পারবে, পুষ্টিকর ও নিরাপদ স্বাস্থ্যকর খাদ্য সহজলভ্য থাকবে। অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তার মূল বিষয় তিনটি (১) খাদ্যের সহজ প্রাপ্যতা (২) খাদ্যের লভ্যতা (৩) স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্য। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য করণীয় হচ্ছে- (১) ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো (২) খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি (৩) আবাদি জমি বাড়ানো (৪) প্রাকৃতিক দুর্যোগসহনশীল জাত উদ্ভাবন (৫) জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন (৬) আন্ত:ফসল, মিশ্রফসল, রিলেফসল, রেটুন ফসল চাষ করা (৭) সেচের জমি বৃদ্ধি করা (৮) উফশী ও হাইব্রিড ফসল চাষ করা (৯) শস্য বহুমুখীকরণ করা (১০) জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত ও প্রচুর চারা উৎপাদন করা (১১) রোগ বালাই দমন করা (১২) প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করা (১৩) ধানক্ষেতে মাছ চাষ, পুকুরে মাছ-মুরগি-হাঁসের সমন্বিত চাষ করা (১৪) রোগ ও পোকা দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা (১৫) সহজ শর্তে ঋণ দেয়া (১৬) পশুপাখির জন্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা (১৭) ভর্তুকি বাড়ানো (১৮) সংরক্ষণাগার বাড়ানো (১৯) কৃষি উপকরণ সরবরাহ (২০) শস্যবীমা চালু করা (২১) পতিত জলাশয়ে মাছ চাষ করা ইত্যাদি। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা কঠিন কাজ, কারো একার পক্ষে সম্ভব না।
পৃথিবী এখন সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্য সংকটে আছে। কারণ, পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে গাণিতিক হারে। অপরদিকে, আবাদি জমি কমছে, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি উপকরণ সংকটসহ হাজারো সমস্যার জন্য কৃষি উৎপাদন কাঙ্খিত পর্যায়ে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এর হিসেবে পৃথিবীতে বর্তমানে ২২টি দেশ বেশি খাদ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির সূচকের তালিকায় ১৯৬টি দেশ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭, পাকিস্তানের ২২, ভারতের ৫১ ও চীন ১২৫ তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিশ্বে ক্ষুধা নামক নীরব ঘাতকের হাতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যাচ্ছে। ৮৫২ মিলিয়ন লোক ক্ষুধার্ত থাকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা ও আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালের বিশ্বের ৮২ কোটি ১০ লাখ লোক ছিল অপুষ্টির শিকার। অর্থাৎ বিশ্বের প্রতি ৯ জন মানুষের ১ জন পুষ্টি পায় না। পাঁচ বছর থেকে কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ১৫ কোটির দৈহিক স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে না পুষ্টি হীনতায়। এই সংখ্যা বিশ্বের মোট শিশুর ২২ শতাংশ।
একমাত্র কৃষির মাধ্যমেই বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করা সম্ভব। কারণ সবাই কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির সকল পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ক্রয়-বিক্রয় করে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। বাংলাদেশ বিভিন্ন ফসল, শাক-সবজি, ফল, মসলা, মাশরুম, বীজ উৎপাদন, গরু মোটাতাজাকরণ, দুগ্ধ শিল্প, ছাগল পালন, মহিষ পালন, ব্রয়লার-লেয়ার পালন, কোয়েল, টার্কি, তিতির, কবুতর, হাঁস পালন, মাছ চাষ, চিংড়ি চাষ, পোনা উৎপাদন, সামাজিক বনায়ন, ফুল চাষ, জৈবসার তৈরি, বায়োগ্যাস তৈরিসহ ক্ষুধামুক্তির বিভিন্ন উপকরণ নিরলস ভাবে গবেষণা ও উৎপাদন করে যাচ্ছে।
আশা করছি, দেশের কৃষক, কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি মিডিয়া, কৃষিকর্মী, কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও কৃষি ব্যক্তিত্ব সহ সবাই মিলে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়বে।
লেখক- সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত লেখক। সম্পাদক- কৃষি প্রতিক্ষণ (অনলাইন পত্রিকা)