ড. মো. হুমায়ুন কবীর।।
বর্তমান সরকারের একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইশতেহার হলো গ্রামকে আস্তে আস্তে শহরে রূপান্তর করা। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কারণ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সব গ্রামই একেবারে শহর হয়ে যাবে বিষয়টি আসলে এমনটি নয়। আসলে বিষয়টি হলো শহরের সুযোগ-সুবিধাগুলোকে গ্রামের দিকে সম্প্রসারিত করবে দিনে দিনে। কিন্তু এতে যে বিষয়টি প্রাথমিকভাবে সমস্যা হয়ে দেখা দেবে সেটি হলো কৃষি জমি হ্রাস পাওয়া। কারণ এমনিতেই প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে প্রতিক্ষণে প্রতিবছরে একটি নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট পরিমাণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। কৃষি জমি কমে গেলে কমে যাবে কৃষি উৎপাদন। হুমকির মুখে পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা। কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগে এ সমস্যাকেও সচেতনভাবে সমাধান করা সম্ভব।
বর্তমানে কৃষিতে যতটুকু পরিমাণ কৃষি জমি রয়েছে সেটুকু দিয়ে উচ্চফলনশীল, হাইব্রিড ফসলের জাত ব্যবহার, আধুনিক ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে চাহিদা মেটানো সম্ভব। সর্বাধিক ফলনে কৃষি আজ বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। অন্যদিকে যেহেতু কৃষি একটি প্রয়োগিক বিজ্ঞান এবং প্রতিমুহূর্তে কৃষিকে নিয়ে নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে একে যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিজ্ঞানীগণ কাজ করে চলেছে। সেজন্য জমি কমলেও বাড়তি কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে সেটাকে অভিযোজন করা সম্ভব। তবুও সেটার একটি মাত্রা রয়েছে। যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত হারে কৃষি জমি আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে তখন তা অশনি সংকেত বয়ে আনতে পারে। সেজন্য যেসব কারণে কৃষি জমি কমছে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ অহেতুক কৃষি জমি কমতে পারে এমন কোন উচ্চাভিলাসী উদ্যোগ পরিহার করতে হবে।
এখন আসা যাক, কী কী কারণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। বেশিরভাগই হলো মানুষের দ্বারা সৃষ্ট কারণ, তবে কিছু প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। মনুষ্য সৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান হলো শিল্প কল-কারখানা তৈরী, রাস্তা-ঘাট তৈরী, হাট-বাজার তৈরী, বাড়ি-ঘর নির্মাণ, ই্টভাটা নির্মাণ, অপরিকল্পিত দ্রুত নগরায়ন, স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী, মসজিদ, মন্দিরসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরী, নতুন নতুন অবকাঠামো ও স্থাপনা তৈরী, অপরিকল্পিত বনায়ন ইত্যাদি। অপরদিকে প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- নদী ভাঙন, সাগরে বিলীন হওয়া ইত্যাদি। তবে কিছু কিছু কারণে আবার অল্প পরিমাণে কৃষি জমি অবমুক্ত হয়ে যুক্তও হচ্ছে । খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড়, পুকুর-জলাশয় ইত্যাদি ভরাট হয়ে কিছু কৃষি জমি প্রকৃতিতে যোগ হয়।
যেহেতু কৃষি জমি বাড়ানো সম্ভব নয়, আবার খাদ্যা মেটানোর জন্য উৎপাদনও অপরিহার্য। আবার অবকাঠামো ও স্থাপনা তৈরীও একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেজন্য কোনটিকেই বাদ দেওয়া যাবে না। করতে হবে সমন্বয়। রাস্তা-ঘাট করার জন্য ফ্লাইওভার তৈরীর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। অর্থাৎ আনুভূমিক দিকে স্থাপনা না বাড়িয়ে উলম্ব দিকে বাড়াতে হবে। একতলা ভবনের পরিবর্তে বহুতল ভবন তৈরী করতে হবে। ইটভাটা নির্মাণের জন্য অনেক জায়গা ব্যবহার করে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে কম জায়গা ব্যবহারের আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে গবেষণার মাধ্যমে আরো নতুন নতুন আইডিয়া সৃষ্টি করতে হবে।
কৃষি জমি যে হারে কমছে সেই হারেই ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে তা পূরণ করতে হবে। আমরা সকলেই সহজ ও সরল হিসাবটি বুঝতে পারি। আর সেটি হলো কৃষি জমি কমে গেলে কৃষি ফসল উৎপাদনই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। তাই কম খাদ্যে বেশি পরিমাণ পুষ্টি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, কৃষি বহুমুখীকরণ, ফসল ফলানোর মৌসুম বৃদ্ধি করা, কমদিনে ফলে এমন ফসলের বিভিন্ন জাত সৃষ্টি করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে ফসলহানি থেকে রক্ষা করা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে কৃষিকে রক্ষা করা, পুষ্টিসম্মত খাবার গ্রহণের বিষয়ে নাগরিকদেরকে সচেতন করা ইত্যাদি।
তাছাড়া কৃষি জমি রক্ষার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নদীর জেগে উঠা চরকে দ্রুত কৃষি জমির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অপরদিকে নদী ভাঙন রোধ করার জন্য নদীর পাড় বাঁধাই করা একটি বড় উদ্যোগ হতে পারে। এভাবে সচেতনতা সৃষ্টি ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই কৃষি জমি কমতিজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। এভাবেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়