কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ।।
কৃষি বাংলাদেশের মূল চালিকা শক্তি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকাংশ উপাদান আসে কৃষি থেকে। খাদ্যের একমাত্র উৎস কৃষি। কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছে কৃষক ও কৃষিবিদরা।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে সফলতা অর্জন হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন হয়েছে কৃষি ক্ষেত্রে । কারণ ৪৬ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। জমি কমেছে অথচ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। প্রতি এক শতাংশ হারে বছরে ৫০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ছে ১.৪৭ শতাংশ হারে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন।
রোদ, বৃষ্টি, শীত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষিতে বিপ্লব অভাব অনটন, ক্ষুধাসহ হাজারো সমস্যা উপেক্ষা করে খাদ্য উৎপাদন করছেন দেশের প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের জন্য। অথচ কৃষক অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত। ৪৬ বছরে কৃষিতে অনেক উন্নতি হলেও উন্নতি হয়নি কৃষকের। খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করছেন, কৃষক কৃষি বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণ বিভাগ, কৃষিবিদ, এনজিও, মিডিয়াসহ অনেকেই।
১৯৭১ সালে দেশে চালের উৎপাদন ছিল এক কোটি দুই লাখ মেট্রিক টন। তখন খাদ্য সংকট ছিল চরমে। বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে চালের উৎপাদন তিন কোটি ৮৬ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন। বিদেশে চাল রপ্তানি করছে ১৯৭১ সালে হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিল ১.০৫ টন। এখন সাড়ে তিন টন। বর্তমানে দেশে শস্য নিবিড়তা ১৯৪ শতাংশ, কৃষি ক্ষেত্রে জিডিপির অবদান ১৪.২২ শতাংশ, কৃষিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২.১৭ শতাংশ, পশুসম্পদের অবদান ১.৬০ শতাংশ ও মৎস্য সম্পদের অবদান ৩.৬৫ শতাংশ। ধান ও মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ এবং সবজি উৎপাদনে তৃতীয়।
দেশে এখন কৃষিতে কৃত্রিম উপগ্রহ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ওয়েবসাইট, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। দেশের ১৩টি জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অসংখ্য লাগসই প্রযুক্তিসহ প্রায় ৬ শতাধিক ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট- ৩৩৬ টি ফসলের উন্নতজাতসহ ৬৪৫টি প্রযুক্তি, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ধানের চারটি হাইব্রিডসহ- ৯৪টি, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট- ৪৭টি ফসল, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইন্সটিটিউট ইক্ষুর ৩৪টি, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট পাটের ৩৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট মাছের, বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট গবাদি পশু ও হাঁসমুরগি, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট চা-এর জাত ও উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। মৃত্তিকা সম্পাদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট মাটি পরীক্ষার জন্য ১৮১০টি মিনিল্যাব স্থাপন করে ৯০ হাজার মাটির নমুনা পরীক্ষা করছে।
২৩০টি উপজেলার কৃষক ওয়েবসাইট থেকে সারের মাত্রা জানতে পারছেন। পাটের জেনোম সিকোয়েন্স আবিস্কার হয়েছে। ফলে পাটের বহুমুখী ব্যবহার সম্ভব হবে। ইক্ষু উৎপাদন ও বিপননে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। প্রাণি বিজ্ঞানীরা শুভ্রা নামে ডিম পাড়া মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। এ জাতের মুরগিবছরে ২৮০ থেকে ২৯৫টি ডিম দেয়। দেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা জেনেটিক গবেষণায় দেশীয় রুই ও কৈ-মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে যা শতকরা ১৫ ও ৪৫ ভাগ বেশি উৎপাদনশীল। বাংলাদেশের পুকুরে মুক্তা চাষ সফল হয়েছে।
গ্রিণ হাউস পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা গলদা চিংড়ির আগাম ব্রুড উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবন করেছে। মটি ও জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৭টি ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। ইউনিয়ন ও ব্লক পর্যায়ে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র চালু হয়েছে। যেখান থেকে কৃষকরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক তথ্য পাচ্ছেন। বাড়িতে কৃষির তথ্য ও সমস্যার সমাধান জানতে পারেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও কৃষির সমস্যার সমাধান ও তথ্য জানতে পারেন। ব্রি জিংক সমৃদ্ধ ধানের জাত বিআর ৬২ উদ্ভাবন করেছে। এই চালের ভাত খেলে দেহে জিংকের অভাব পূরণ হবে। মঙ্গা এলাকার জন্য ধানের ৪টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
১৯৭১ সনে আবাদি জমির ১৫ শতাংশ সেচের আওতায় ছিল, এখন তা বেড়ে ৫৮ শতাংশ উন্নীত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আইপিএম ও আইসএম কার্যক্রমের আওতায় মোট ২২ হাজার ৯৬২টি কৃষক মাঠ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৭৪ হাজার ৫০ জন কৃষককে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেয়া হয়েছে ২ কোটি ৫ লক্ষ ৪৪ হাজার ২০৮ জনকে। ১০ টাকায় কৃষকদের ব্যাংকে হিসাব খোলার সুযোগ দেয়ায় ৯১ লক্ষ ৯০ হাজার ৬৪টি হিসাব খোলা হয়েছে। বছরে আগে একটি জমিতে ২টি ফসল চাষ হত। এখন ৩টি ফসল চাষ হয়। চারটি ফসল চাষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
কৃষিতে বহুমুখী প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগের জন্যই আজ প্রচুর খাদ্য পাওয়া যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমি হ্রাস সত্ত্বেও খাদ্য সংকট নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য পরিবর্তিত জলবায়ুতে চাষাবাদ উপযোগী জাত উদ্ভাবন, কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া, জ্বালানি সংকট নিরসন, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনমুখী করা, কৃষি জমি রক্ষা, ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষকের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা, উৎপাদন খরচ কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা যেমন কঠিন তেমনি খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত লেখক। সহকারী অধ্যাপক শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূয়াপুর, টাঙ্গাইল। মোবাইল : ০১৭১১-৯৫৪১৪৩