কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ: ধান চাষে এজোলা প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত উন্নতমানের নাইট্রোজেন জৈব সার। এজোলা ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন খরচ কমে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, মাটির উর্বরতা বাড়বে, পরিবেশ ভালো থাকবে। এ ছাড়া এজোলা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর উৎকৃষ্ট আমিষজাতীয় খাদ্য। এজোলা বর্জ্য পানি পরিশোধনে ভূমিকা পালন করে। প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া লাগে। এজোলা ব্যবহার করে ১৫ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সাশ্রয় করা সম্ভব। এ নিয়ে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ায় ফসলের উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট থাকায় ইউরিয়ার উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না, দামও কমানো সম্ভব নয়। ইউরিয়া বা নাইট্রোজেনজাতীয় সার ছাড়া ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। ইউরিয়ার পরিবর্তে এজোলা ব্যবহার করে ইউরিয়ার চাহিদা বা ঘাটতি পূরণ করা যায়। ইউরিয়া সারের দাম বেশি। ফসলের উৎপাদন খরচ বেশি হয়, মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করে, পরিবেশ দূষিত করে, সর্বোপরি ক্ষতিকর। অন্যদিকে এজোলা প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত উন্নতমানের নাইট্রোজেন প্রধান জৈব সার। এজোলা উৎপাদনে খরচ লাগে না, ফসলের উৎপাদন খরচ কমবে, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, মাটির উর্বরতা বাড়বে, পরিবেশ ভালো থাকবে, সর্বোপরি উপকারী। এ ছাড়া এজোলা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর উৎকৃষ্ট আমিষজাতীয় খাদ্য। এজোলা বর্জ্য পানি পরিশোধনে ভূমিকা পালন করে। প্রতি বছর দেশের প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া লাগে। এজোলা ব্যবহার করে ১৫ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সাশ্রয় করা সম্ভব।
পরিচিতি : এজোলা ক্ষুদিপানা, তেঁতুলিয়াপানা, বুটিপানা, কুটিপানা ইত্যাদি নামে পরিচিত। এজোলা ফার্নজাতীয় ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ। তাই ধান ক্ষেত, পুকুর, ডোবা, খাল, বদ্ধ পানি ও নদীর পানিতে জন্মে। এর ভাসমান গুচ্ছগুলো ত্রিকোণাকার। প্রতিটি গুচ্ছের দৈর্ঘ্য ১০-১৫ মিলিলিটার এবং প্রস্থে ১০-১২ মিলিলিটার হয়। প্রতিটি ভাসমান গুচ্ছের প্রধান কা-ের উভয় দিক থেকে ৮-৯টি শাখা বের হয়। প্রতিটি শাখায় ১০-১২টি পাতা উভয় দিকে একটির পর একটি সাজানো থাকে।
বংশ বৃদ্ধি : যৌন (বীজ) ও অযৌন (অঙ্গজ) উভয় পদ্ধতিতে এজোলা বংশ বৃদ্ধি করে। পানিতে ভাসমান অবস্থায় এজোলার বংশ বৃদ্ধি ভালো হয়। কাদামাটিতে এজোলা বেঁচে থাকতে পারে। সাধারণত ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাই এর অঙ্গজ বংশ বিস্তার দ্রুত হয়। তাপমাত্রা বেশি হলে যেমন চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রচ- গরম ও প্রখর রোদে এজোলা বংশ বৃদ্ধি করে না, তবে বেঁচে থাকে।
সার হিসেবে ব্যবহার : এজোলাকে আশ্রয় করে একটি নীলাভ সবুজ শেওলা এজোলার পাতার ভেতরে একটি গর্তে অবস্থান করে এবং বড় হয়। শেওলাটি পাতার ভেতরেই বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। পাতার ভেতরে নীলচে সবুজ শেওলার একটি প্রজাতি (এনাবিনা) থাকে। এজোলার প্রতিটি পাতায় ৭৫ হাজার এনাবিনা থাকে। শেওলাটি বাতাস থেকে ৩-৩.৫% নাইট্রোজেন আহরণ করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া তৈরির মাধ্যমে নিজের ও আশ্রয়দাতা এজোলার জন্য নাইট্রোজেন পুষ্টি জোগায়। উল্লেখ্য, গাছ ইউরিয়া সারের মূল উপাদান নাইট্রোজেনকে অ্যামোনিয়াম আয়ন হিসেবে গ্রহণ করে। এজোলা প্রতিদিন হেক্টরে এক টন কাঁচা জৈব সার তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে বাতাস থেকে ২ কেজি নাইট্রোজেন আহরণ করতে পারে যা ৫ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। এজোলা যখন পানির উপরিভাগে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে তখন প্রতি হেক্টরে ১০-১৫ টন কাঁচা জৈব সার ও সেই সঙ্গে ২০-২৫ কেজি নাইট্রোজেন আহরিত হয় যা ৪৫-৫৫ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। কাঁচা এজোলায় শতকরা ৬ ভাগ শুকনো বস্তু থাকে। এতে শতকরা ৩-৪ ভাগ নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ০.২৫-৫.৫ ভাগ, ক্যালসিয়াম ০.৪৫.১.২৫ ভাগ, সিলিকা ০.১৫-১.২৫ ভাগ, সোডিয়াম ০.১৫-১ ভাগ ফসফরাস ০.১৫.১ ভাগ, ক্লোরিন ০.৫-০.৭৫, সালফার ০.২ -০.৭৫ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম ০.২৫-০.৫ ভাগ অ্যালুমিনিয়াম ০.০৪-০.৫ ভাগ, আয়রন ০.০৫-০.৫ ভাগ, ম্যাঙ্গানিজ ৬০-২৫০০ পিপিএম, কপার ২-২৫০ পিপিএম ও জিঙ্ক ২৫-৭৫০ পিপিএম। এজোলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে এগুলো সবই গাছের পুষ্টি হিসেবে গ্রহণ করে।
চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের কৃষকরা ধানক্ষেতে জীবাণুসার হিসেবে এজোলা চাষ করে। এজোলা ধান গাছে নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করে এবং জৈব পদার্থ মিশে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। আমাদের দেশে বোরো ও আমনের জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই এজোলা জন্মে। কৃষকরা না জানা ও না চেনার কারণে আগাছা মনে করে জমি থেকে পরিষ্কার করে ফেলে দেয়। অথচ এজোলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই ১৫ দিনের মধ্যে পচে মাটিতে নাইঙ্গ্রোজেন সরবরাহ করে। অন্যান্য ফসলের জমিতে এজোলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণ করা যায়। রোপা ধানে এজোলা ব্যবহার করে ২০-২৫ ভাগ ফলন বাড়ানো যায়।
জৈব আগাছানাশক : এজোলা পানির উপরিভাগ ঢেকে রাখে বিধায় সূর্যের আলো পানির নিচে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। এতে শ্রমিকের খরচ সাশ্রয় হয়।
প্রাণীর খাদ্য হিসেবে : এজোলা মাছ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়। এজোলায় প্রচুর আমিষ ও চর্বি থাকায় উচ্চমানের খাদ্য তৈরি হয়। রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এজোলায় আমিষ ২০-২৫%, অ্যাশ ১০%, শ্বেতসার ৬-৬.৫%, চর্বি ৩-৩.৫%, দ্রবীভূত সুগার ৩-৩.৫% ও ক্লোরোফিল এ ০.২৫- ০.৫%। এজোলা তৈরি খাদ্যে মুরগির ডিমের উৎপাদন বাড়ায়, কুসুম বেশি হলুদ বর্ণ হয়, ডিম ও মাংসে বেশি আমিষ থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গবাদিপশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও দুধ উৎপাদন বাড়ে। মাছ চাষে পুকুরে পানি বিশুদ্ধ রাখে ও মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এজোলা দিয়ে পশু-পাখি খাদ্য ও মাছের উৎপাদনে খরচ কম হয়।
এজোলা উৎপাদন : বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এজোলা উৎপাদন ও গবেষণা হয়েছে। মজা পুকুর, ডোবা, নালা, খাল, বিল, হাওড়, বাঁওড়ে এজোলা চাষ করা যায়। এ ছাড়া বোরো ও আমন ক্ষেতেও চাষ করে মাটির সঙ্গে মেশানো যায়। প্রাথমিকভাবে প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ গ্রাম সতেজ এজোলা বীজ হিসেবে জলাশয় অথবা ধানের জমিতে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতি হেক্টরে ৮-১০ কেজি টিএসপি ৮-১০ কেজি, ১৫-২০ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশে ১০-২০ দিনের মধ্যে এজোলা অঙ্গজ বংশবিস্তার করে। এজোলা উৎপাদনের জন্য ধানের চারা রোপণের ৫-৭ দিন পর বীজ হিসেবে ১০০-১২০ গ্রাম সতেজ এজোলা জমিতে ছিটাতে হবে। ১৫-২০ দিন পর পর জমির মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয় অথবা উঠিয়ে অন্য জমিতে ব্যবহার করা যায়।
সংরক্ষণ : সারা বছর এজোলার বীজতলা সংরক্ষণ করা যেতে পারে। পুকুর, ডোবা বা বদ্ধ জলাশয়ে সংরক্ষণ করা যায়। অতি বৃষ্টি ও রোদ থেকে রক্ষার জন্য শাক-সবজির মাচা করা যেতে পারে। বীজতলায় সর্বদা ৫-১০ সেমি পানি থাকতে হবে।। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য এক গ্রাম টিএসপি ৮-১০ দিন পর পর দিতে হবে। শামুক ও পোকার কিড়া এজোলার ক্ষতি করে। শামুক বেছে ফেলতে হবে। পোকা দমনের জন্য কার্বোফুরান স্প্রে করা যেতে পারে। এজোলা দেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এ প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগালে ইউরিয়া সাশ্রয় হবে, গ্যাসের সংকট দূর হবে, ফলন বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ রোধ করা, ফসল, মাছ, গবাদিপশু, ডিম ও দুধের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য এজোলা বিরাট ভূমিকা পালন করবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম