কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদঃ আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসহ উন্নত দেশের কৃষকরা কৃষির যেকোনো সমস্যা নিজেরাই ঘরে বসে ওয়েবসাইট বা সফটওয়্যার বা অনলাইন থেকে সংগ্রহ করে সমাধান করে। তারা ঘরে বসে কম্পিউটার ও কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে তার জমির ফসলের অবস্থা দেখে। উড়োজাহাজ দিয়ে জমিতে বীজ বপন, সার, সেচ ও কীটনাশক প্রয়োগ করে। আমাদের দেশের কৃষকভাইয়েরা কি ওয়েবসাইট থেকে তার জমির ফসলের সারের পরিমাণ সংগ্রহ করতে পারবেন? দেশের কৃষকরা কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট ইত্যাদি কিছুই বুঝেন না। অধিকাংশ কৃষক বাংলা ইংরেজি পড়তে পারেন না।
২০০টি উপজেলায় বিভিন্ন ফসলের সুষম সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি ওয়েবসাইটে আছে। এর মাধ্যমে সহজেই কৃষক সারের মাত্রা জেনে সার প্রয়োগ করলে দেশে উৎপাদন বাড়বে। এতে সারের অপচয়ও রোধ হবে। কৃষকরা উপজেলার ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে এসে উদ্যোক্তাদের সহায়তায় সহজেই তার জমির সারের মাত্রা জানতে পারছেন। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লৰ্যে কৃষকের দোরগোড়ায় অনলাইনের সুবিধা পৌঁছানোর এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) অনলাইন থেকে জমির ফসলের সারের পরিমাণ জানার বিষয়ে ইউনিয়ন উদ্যোক্তা ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। মাটি পরিক্ষা করে সার প্রয়োগ করলে সারের অপচয় রোধ হয়, মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে, সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়, উৎপাদন বাড়ে ও উৎপাদন খরচ কমে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাটি পরিক্ষা করে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে ধানের ফলন গড়ে শতকরা ২০-২৫ ভাগ এবং অন্যান্য ফসলে শতকরা ১০-১৫ ভাগ বাড়ে। এতে দেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন ২০ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২৪ মিলিয়ন টনে উন্নীত হবে।
এসআরডিআই ক্যাটালিস্টের সহযোগিতায় মাটিতে ফসলের সারের চাহিদা নিরূপণের সফটওয়্যার তৈরি করেছে। দেশের প্রায় ২০০টি উপজেলায় মাটি পরিক্ষা করে বিভিন্ন পুষ্টির পরিমাণ নির্ণয় করে বিভিন্ন ফসলের পুষ্টির চাহিদা নিরূপণ করে এই সফটওয়্যার তৈরি করেছে। ইতোমধ্যেই ৩০টি এলাকার প্রায় তিন হাজার কৃষক এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে জমিতে সার প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছেন। অনলাইনে www.frs-bd.com অথবা frs-srdi.gov.com এই লিংকে প্রবেশ করতে হবে। তারপর ব্যবহারকারী ও পাসওয়ার্ড হিসেবে উভয় স্থানে srdi দিতে হবে। নতুন পৃষ্ঠা আসবে সেখানে কৃষকের নাম, গ্রাম, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, মাটির ধরন, ফসলের ধরন (শস্য/আঁশ/ডাল/ সবজি/ মসলা ইত্যাদি), ফসলের নাম, জমির পরিমাণ (শতাংশে), ভূমির শ্রেণী (উঁচু/ মাঝারি উঁচু/ মাঝারি নিচু/ নিচু/ অতি নিচু) এবং টিএসপি/ ডিএপি/ ইউরিয়া সিলেক্ট করতে হবে এবং সার্চ দিতে হবে। আপনার জমিতে নির্দিষ্ট ফসলে কতটুকু সার দিতে হবে এবং কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা বের করে দেবে সফটওয়্যার। এসআরডিআই-এর প্রশিক্ষণে উপস্থিত কৃষকদের জমির তথ্য দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই উদ্যোক্তারা এভাবে সারের পরিমাণ বের করে দেখান ল্যাপটপ থেকে। এর জন্য কৃষকদের এখন মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হতে হয় না। উদ্যোক্তরা ল্যাপটপ নিয়ে কৃষকদের বাড়িতে বা জমিতে গিয়ে কৃষিবিষয়ক সেবা দিচ্ছেন। দেশের ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে ২৭টি বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে কৃষকদের সেবা দেয়া হয়। এর মধ্যে কৃষি একটি। এখানে একাধিক ল্যাপটপ, স্ক্যানার, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, ডিজিটাল ক্যামেরাসহ তথ্যপ্রযুক্তির যাবতীয় যন্ত্রপাতির ল্যাব আছে। কৃষকরা ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে এসেও সার সুপারিশসহ কৃষির যেকোনো সেবা নিতে পারছেন। কৃষকরা এসব সেবায় বিস্মিত ও অভিভূত।
মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় সার চাহিদাসহ কৃষি সমস্যার সমাধান জানা যায়। এসআরডিআই এর সাথে গ্রামীণফোন এবং বাংলালিংক চ্যানেল পার্টনার হিসেবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাংলালিংকে ৭৬৭৬ নম্বরে ফোন করে মাটির স্বাস্থ্য, সারের মাত্রা, প্রয়োগ পদ্ধতি জানা যায়। এ সেবা দেশের বিভিন্ন গ্রামে অবস্থিত ৩ হাজারের বেশি টেলিসেন্টার থেকেও কৃষকরা পেতে পারেন। গ্রামীণফোনের কমিউনিটি তথ্য কেন্দ্র থেকেও কৃষক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সার সুপারিশ তথ্য পেতে পারেন। মোবাইল ফোনে জমির ধরন, ফসল, ইউনিয়ন, জেলা ও উপজেলার নাম দিয়ে সার প্রয়োগের পরিমাণ পাওয়া যায়। কৃষকরা নিজেরা ইন্টারনেট অপারেট না করতে পারলেও উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সারের প্রয়োগ মাত্রাসহ কৃষিবিষয়ক যেকোনো সমস্যা ও তথ্য কৃষকরা সহজেই পাচ্ছেন। আশা করি, অচিরেই কৃষকরা নিজেরাই মোবাইল ফোন ব্যবহারের মতো ওয়েবসাইট থেকে ঘরে বসে সারসহ যেকোনো কৃষির তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োগ করতে পারবেন।