কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে চিংড়ির মতো রপ্তানি হবে বাংলাদেশের পাঙাশ মাছ। তবে আস্ত মাছ নয়, রপ্তানি হবে পাঙাশের টুকরো; যাকে বলা হয় ফিশ ফিলে খবর প্রথম আলো। পাঙাশ মাছ থেকে ফিশ ফিলে উৎপাদন করে তা রপ্তানি করতে বিনিয়োগ করেছে চারটি দেশি কোম্পানি। এর মধ্যে একটি ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় পাঙাশের ফিলের ব্যাপক চাহিদা আছে। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের মতো বড় রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার সুযোগ আছে বাংলাদেশের সামনে। ভিয়েতনাম শুধু পাঙাশের ফিলে রপ্তানি করেই বছরে দেড় শ কোটি ডলারের বেশি আয় করে। তবে আমেরিকা সম্প্রতি ভিয়েতনামের পাঙাশের ফিলের ওপর উচ্চহারে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশের পক্ষে বাজার ধরা আরও সহজ হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা।
ফিলে শব্দটির অর্থ হলো কাঁটাবিহীন টুকরো। উন্নত বিশ্বে তেলাপিয়া ও পাঙাশের ফিলের বড় বাজার আছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে পাঙাশের ফিলে রপ্তানি করে এখন প্রতিযোগিতায় টেকা যাবে। তবে তেলাপিয়ার বাজার ধরা সহজ হবে না। কারণ, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো অনেক কম দরে তেলাপিয়ার ফিলে রপ্তানি করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বাংলাদেশ মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে এখন চতুর্থ অবস্থানে আছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ ৭ হাজার টন পাঙাশ মাছ উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।
দেশীয় উদ্যোক্তারা জানান, একটি পাঙাশ কেটে সেখান থেকে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ফিলে; মাথা ও লেজের মাংস দিয়ে মাছের খাবারের উপাদান ফিশ মিল; পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি দিয়ে মাছের তেল; মেরুদণ্ডের হার দিয়ে ক্যাপসুলের খোলসের উপাদান জিলেটিন এবং চামড়া দিয়ে কসমেটিক সার্জারির একটি উপকরণ তৈরি করা যায়। পাঙাশ মাছ থেকে ফিলে তৈরির জন্য বিনিয়োগ করেছে ভারগো ফিশ অ্যান্ড অ্যাগ্রো প্রসেস, আর্থ অ্যাগ্রো ফার্মস, গ্লোব ফিশারিজ ও এস অ্যান্ড কে অ্যাসোসিয়েটস। এদের মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রতিদিন ২২০ টন। পাঙাশ মাছ থেকে এরা ফিলের পাশাপাশি ফিশ মিল ও তেল উৎপাদন করবে। দেশের বাজারে এ দুটি উপকরণের চাহিদা ব্যাপক।
ভারগো ফিশ অ্যান্ড অ্যাগ্রো প্রসেসের ময়মনসিংহের কারখানায় গত এপ্রিল থেকে উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে রপ্তানি শুরু হয়নি। কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানির মানসনদ পেতে কাজ করছেন। দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তাঁরা রপ্তানি শুরু করতে পারবেন। ভারগোর উৎপাদনক্ষমতা দিনে ৩০ টন। এখন তাদের উৎপাদিত ফিশ ফিলে সুপারশপ আগোরায় বিক্রি হচ্ছে।
আর্থ অ্যাগ্রো ফার্মসের কারখানা রাজেন্দ্রপুরে। তাদের উৎপাদনক্ষমতা দিনে ৬০ টন। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল মোসাদ্দেক চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের ঈদুল ফিতরের পরপরই উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। তবে গুলশানে জঙ্গি হামলার পর তাঁদের কারখানায় কর্মরত ডেনমার্কের একজন প্রকৌশলী বাংলাদেশে আসতে বিলম্ব করায় উৎপাদন দু-এক মাস পেছাতে হয়েছে। গ্লোব ফিশারিজের ফিলে উৎপাদনক্ষমতা হবে দিনে ১০০ টন। তারা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে তাদের কারখানার নির্মাণকাজ প্রায় ৫০ শতাংশ শেষ করেছে। যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে।
কোম্পানিটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) শাকের শামীম প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের নিজস্ব ৪০০ একর জমিতে মাছ চাষ করা হবে। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক চাষের মাধ্যমে পাঙাশ মাছ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করবেন তাঁরা। তাঁদের কারখানায় পাঙাশের উপজাত থেকে ফিশ মিল উৎপাদন করা হবে। ওই ফিশ মিল নিজেদের মাছের খাবার তৈরির কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করার কথাও জানিয়েছেন তিনি। শাকের শামীম বলেন, ‘আগামী জানুয়ারি নাগাদ আমরা উৎপাদনে যাব। রপ্তানির জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইতে একটি ওয়্যার হাউস তৈরি করা হচ্ছে। সেখান থেকে ফিলে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হবে।’ পাঙাশের ফিলের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য ভিয়েতনামের। তবে গত দুই বছর তাদের রপ্তানি কমেছে। ২০১৫ সালে ভিয়েতনাম পাঙাশের ফিলে রপ্তানি করেছে প্রায় ১৬০ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ কম। ভিয়েতনামের দৈনিক পত্রিকা ভিয়েতনাম নিউজ-এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতি কিলোগ্রাম ফিশ ফিলের ওপর গড়ে শূন্য দশমিক ৬৯ ডলার অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে, যা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশে নতুন কোম্পানিগুলোকে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে দেওয়া ও বাজার ধরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে প্রাইমেক্স করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী জিয়াউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে শুল্কহার বেড়ে যাওয়ায় ভিয়েতনাম বিপাকে পড়েছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। কারণ, এখন বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে কম দামে ফিলে রপ্তানি করতে পারবে। ওই ব্যবসায়ী বলেন, ভিয়েতনামের জায়গাটি ভারত নিতে পারত। তবে ভারতের সমস্যা হলো তাদের বাংলাদেশের মতো এত জলাশয় নেই। আর্থ অ্যাগ্রোর মাহবুবুল মোসাদ্দেক চৌধুরী জানান, ভিয়েতনাম ২০০১ থেকে ফিলে রপ্তানি শুরু করে।
তবে তাদের ফিলে বাজার পায় ২০০৬ সাল থেকে। তখন বৈশ্বিক মন্দার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে যায়। ফলে স্যামনের ফিলের বদলে পাঙাশের ফিলে খাওয়া শুরু করে ইউরোপ ও আমেরিকার সাধারণ মানুষ। ২৫০ গ্রাম স্যামনের ফিলের দাম যেখানে ১০ থেকে ১২ ডলার পড়ত, সেখানে পাঙাশের ফিলের দাম পড়ে ৩ থেকে ৪ ডলার। ওই ব্যবসায়ী আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ সাল থেকে পাঙাশের ফিলে আমদানি শুরু করে।
তিন বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সামুদ্রিক খাবারের তালিকায় এটি ৬ নম্বরে চলে এসেছে। বাংলাদেশকে ফিলের বাজার ধরতে মানসম্মত চাষ, মাছের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকসহ ক্ষতিকর উপাদান না থাকা এবং এখনকার দামে প্রতি কেজি পাঙাশের বাজারমূল্য ৮০ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে রাখতে হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। তাঁরা জানান, শুধু ইউরোপ ও আমেরিকা নয়; চীন, হংকং, সৌদি আরব, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঙাশের ফিলের বাজার আছে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম