কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ঝালকাঠি জেলায় এ বছর বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে কিছু কিছু পেয়ারা বাগানে পেয়ারার গায়ে দেখা দিয়েছে ছিটেপড়া রোগ। এতে শতশত চাষি ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। আর যেসব চাষির বাগানের ফলন ভাল হয়েছে, তাদের উৎপাদিত ফল কিনে নিচ্ছে পাইকাররা। এদিকে ভরা মৌসুমে জমে উঠেছে ঝালকাঠির ভীমরুলী খালে ভাসমান পেয়ারার হাট। পেয়ারা বাগান ও ভাসমান হাটকে ঘিরে এ বছর হাজার হাজার পর্যটক আসছে এখানে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পুষ্টিগুণে ভরপুর পেয়ারার একশ প্রজাতি রয়েছে। তবে বরিশালে লতা ও পূর্ণমন্ডলী নামে প্রজাতির চাষ হয়ে থাকে। পেয়ারার আদি জন্মস্থান আমিরিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশের মাটিতে কিভাবে পেয়ারা চাষ শুরু হল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। স্থানীয় চাষিদের মুখেমুখে যে ইতিহাস তা থেকে জানা যায় ভারত থেকে প্রথম বরিশালে পেয়ারার বীজ বা চারা আসে। পেয়ারা অঞ্চলে বংশানুক্রমে যারা পেয়ারা চাষ করছেন তারা জানান স্থানীয় কালীচরন মজুমদার নামের একজন ভারতের গয়া থেকে পেয়ারার বীজ এনে প্রথমে এ অঞ্চলে রোপণ করেন। গয়া থেকে আসার কারণে বরিশালের কোন কোন অঞ্চলে পেয়ারাকে গইয়া বলা হয়। আগে পেয়ারার বিচ্ছিন্ন আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে পেয়ারার বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয়।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় পেয়ারা পুষ্টিমাণ সমৃদ্ধ বলেই একে বাংলার আপেল বলা হয়। ঝালকাঠির চাষিরা প্রায় কয়েকশত বছর ধরে চাষ করে আসছেন পেয়ারা। ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা, ভীমরুলী, শতাদাশকাঠি, খাজুরা, মিরাকাঠি, ডুমুরিয়া, জগদিশপুর, খোদ্রপাড়া, পোষন্ডা, হিমানন্দকাঠি, বেতরা, কাপড়কাঠিসহ ১৩ গ্রামে, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানা, আদমকাঠিসহ ২৬ গ্রামে এবং বানাড়ীপাড়া উপজেলার ১৬ গ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে পেয়ারা বাগান।
ঝালকাঠির ৬৫০ হেক্টর বিস্তৃত বাগানে প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকার পেয়ারা উৎপাদিত হয়। তবে এবছর কিছু কিছু পেয়ারায় ছিটপড়া রোগ দেখা দিয়েছে। এতে পেয়ারা বাজারজাত করণের দুশ্চিন্তায় ভুগছেন অনেক চাষি। তার পরেও ভরা মৌসুম শুরু হওয়ায় কৃষকরা ব্যস্ত কচকচে কাঁচা ও পাকা পেয়ারার বাগান থেকে তুলে বাজারজাত করার কাজে। এখানকার পেয়ারা বাজারজাত করার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভীমরুলীর খালে বসে ভাসমান পেয়ারার হাট। ছোট ছোট নৌকায় করে চাষিরা বাগান থেকে ভাসমান হাটে নিয়ে আসেন পেয়ারা। পাইকাররা এই পেয়ারা কিনে ট্রলারে করে নিয়ে যান দেশের বিভিন্নস্থানে। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় সড়ক পথেও বাজারজাত হচ্ছে পেয়ারা।
শতদশকাঠি গ্রামের শিপলু হালদার বলেন, আমার এক একর ২৫ শতাংশ জমিতে পেয়ারার বাগান রয়েছে। ফলনও ভাল হয়েছে। মহাজনদের কাছ থেকে ঋণনিয়ে পেয়ারার চাষ করেছি। স্থানীয় বাজারে পেয়ারা পানির দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা পেয়ারা মহাজনদের কাছে বিক্রি করি। মহাজনরা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এতে মধ্যত্বভোগী মহাজন ও পাইকাররাই বেশি লাভবান হচ্ছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীর মত বড় শহরে এ অঞ্চলের পেয়ারার কেজি ৫০/৬০ টাকা হলেও এখানে তা বিক্রি হচ্ছে ৫/৬ টাকায়। এক মণ পেয়ারার টাকায় পাঁচ কেজি চাল মিলছে না বলে পেয়ারা চাষিরা অভিযোগ করেন। পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে কোন হিমাগার নেই। হিমাগার থাকলে পেয়ারা মজুদ করে দেশের বিভিন্নস্থানে চাষিরাই পৌঁছে দিতে পারতেন বলে জানিয়েছেন তারা।
শতদশকাঠি গ্রামের ইন্দ্রজিত মন্ডল বলেন, আমরা বাগান থেকে সকালে পেয়ারা পেরে নৌকায় করে ভীমরুলী খালের ভাসমান হাটে নিয়ে আসি। বিকেলের মধ্যে পেয়ারা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ দ্রুত পচনশীল এ ফল সংরক্ষণে রাখার জন্য এখানে কোন হিমাগার নেই। যদি একটি হিমাগার থাকতো তাহলেও বেশি দামের জন্য অপেক্ষা করা যেত। ভীমরুলী গ্রামের অজিত দুয়ারি জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত বড় শহরে এ অঞ্চলের পেয়ারার কেজি ৩০/৩৫ টাকা হলেও এখানে তা বিক্রি হচ্ছে ৫/৬ টাকায়। এখান থেকে ১২ কিমি: দূরে ঝালকাঠি শহরে এই পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে বিশ টাকা কেজি। পেয়ারা চাষি ভবেন্দ্রনাথ হালদার বলেন, প্রাণ কোম্পানি জেলি তৈরির জন্য এ বছর চাষিদের কাছ থেকে কিছু পেয়ারা কিনেছে। প্রতিবছর তাদের মত বড় বড় কোম্পানি যদি জেলি তৈরির জন্য এখান থেকে পেয়ারা কিনতো তাহলে আমরা বেশি লাভবান হতাম। আর সবচেয়ে ভাল হতো ভীমরুলী গ্রামে জেলি কারখানা স্থাপন করলে আমরা সেখানেই পেয়ারা বিক্রি করে দিতে পারতাম।
এখানকার পেয়ারা চাষিদের কাছ থেকে কিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পৌঁছে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে যেমন তারা লাভবান হচ্ছেন তেমনি বাংলার আপেলকে তুলে দিচ্ছেন ক্রেতাদের হাতে। ভীমরুলী গ্রামের পেয়ারার আড়তদার (মহাজন) লিটন হালদার বলেন, সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করেও পেয়ারা চাষিরা ঋণের বোঝা মুক্ত হতে পারছেন না। দারিদ্রতা আঁকড়ে ধরেছে তাদের জীবনযাত্রাকে। আমরা যতটা পারি তাদের সহায়তা করে থাকি। নিজেদের লাভের কথা চিন্তা না করে, চাষিদের সংসারের চিন্তা আমাদের আছে।
পেয়ারার আড়তদার কালু হালদার বলেন, এখন পেয়ারার ভরা মৌসুম চলছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চাষিদের কাছ থেকে আনা পেয়ারা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এখন ৪/৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হলেও কিছুদিন পরে দাম পরে যাবে। তখন এক টাকা কেজি দরেও পেয়ারা বিক্রি করতে হবে।
ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ আবুবক্কর সিদ্দিক বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পেয়ারা চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পেয়ারা চাষিদের কথা চিন্তা করে ভীমরুলী গ্রামে দুইটি কৃষিপণ্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করা হবে। আশাকরি এতে চাষিদের কিছুটা হলেও দুঃখ লাগব হবে। শুধু পেয়ারা কিনতেই নয়, বিশাল বাগান আর পেয়ারার এই ভাসমান হাট দেখতে পর্যটকরাও ঘুরতে আসেন এখানে। শত শত পর্যটক দল বেঁধে, কেউ আবার পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দ হইহুল্লোরে সময় কাটিয়ে যান। ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা ইসরাত ফারহানা বলেন, পেয়ারা বাগান ও ভাসমান হাটকে ঘিরে অসাধারণ একটি পর্যটন স্পট গড়ে উঠেছে ভীমরুলী গ্রামে। এখানে পর্যটকদের থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। তারপরও এখানের অপার সৌন্দর্য আমাদের বিমোহিত করে। ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মো. রাশেদ বলেন, বিদেশে আমরা ঘুরতে গিয়ে ভাসমান হাট দেখেছি। কিন্তু আমার দেশেও একটি পর্যটন স্পট রয়েছে, তা আগে জানতামনা। খবরের কাগজে, টিভিতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভীমরুলী পেয়ারা বাগান ও হাটের ছবি দেখে বন্ধুরা মিলে এখানে ঘুরতে এসেছি।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে হিমাগার নির্মান ও জ্যাম জেলির কারখানা গড়ে উঠবে, আর পেয়ারা চাষিদের মুখে হাঁসি ফুটবে এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের। ঝালকাঠি প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি মানিক রায় বলেন ঝালকাঠি ও স্বরুপকাঠি এলাকার পেয়ারা বাগানের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা পেয়ারা বাগানে আস্তানা গেড়েছিল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাই রাজাকার বাহিনী দিয়ে পেয়ারা বাগান কাটা শুরু করেছিল। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের ধারক আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে, তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি এ অঞ্চলে।
সুত্রঃ বাসস / রিপোর্ট ॥ মো. আক্কাস সিকদার ॥