কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এক থেকে দেড় ফুট গাঢ় পলিথিনের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। এতে একদিকে ক্রমে ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলী, অপরদিকে মাছ এবং জীববৈচিত্র্যের উপর পড়ছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব। পরিস্থিতি এতই চরম যে, নদী ড্রেজিং এর এক্সকেভেটর মাটি কাটতে পারছে না, পলিথিনে পিছলে যাচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক ড্রেজিং প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে। জানা গেছে, চট্টগ্রামে প্রতি মাসে গড়ে বিশ কোটি পলিথিন বিক্রি হচ্ছে। আর নানা হাত ঘুরে এসব পলিথিনের ঠাঁই হচ্ছে খাল ও নদীতে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে কর্ণফুলী নদী মৎস্যশূন্য হয়ে পড়ার আশংকাও প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নদীর মাছের খাবার সংগ্রহ হয় মাটি থেকে। কিন্তু কর্ণফুলীর তলদেশে মাটির উপর থরে থরে রয়েছে পলিথিন। এতে করে মাছ মাটি থেকে খাবার পাচ্ছে না। এটা ক্রমে নদীর মাছ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে । কর্ণফুলীর বিভিন্ন পয়েন্টে বছর জুড়ে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নদীর তলদেশে পলিথিন জমার কারণে ড্রেজিং কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক বেশি সময় ব্যয় করেও প্রত্যাশিত খনন কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। এতে ড্রেজিং খাতে বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ড্রেজিং কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, নদীর তলদেশে পলিথিনের উপর জমছে পলিথিন। এক থেকে দেড় ফুটের পলিথিনের স্তরে চাপা পড়েছে মাটি। এতে এক্সকেভেটর পিছলে যাওয়ায় ড্রেজিং এর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সরকার দেশে পলিথিন উৎপাদন এবং বিপণন নিষিদ্ধ করে। পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। কিন্তু অতি মুনাফার কারণে একটি প্রভাবশালী চক্র প্রতিদিনই লাখ লাখ পলিথিন উৎপাদন এবং বাজারজাত করছে। সূত্রমতে, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে চক্রটি এ পলিথিন বাজারে ছাড়ছে। এতে পলিথিন নিষিদ্ধকরণ এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানোর সরকারের সব উদ্যোগই মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশের ঢাকা নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা অসংখ্য পলিথিন কারখানা সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে এসব কারখানার অধিকাংশটিই গোপনে উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে এসব পলিথিন সারা দেশে কমবেশি প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, নগরীর চাক্তাইকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয়। ১০/১২ জন অসাধু ব্যবসায়ীর একটি সিন্ডিকেট চাক্তাই ওসমানিয়া গলি, মসজিদ গলিসহ কয়েকটি স্থানে গুদাম করে কোটি কোটি টাকার পলিথিন সংরক্ষণ এবং বাজারজাত করে। কেবল নগরীতে নয় মফস্বলেও পলিথিন সরবরাহ দেয়া হয় এখান থেকে। জানা গেছে, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে প্রতিমাসে গড়ে পনের ট্রাক পলিথিন বিক্রি হয়। প্রতিটি ট্রাকে ১৩০ থেকে ১৪০ বস্তা পলিথিন থাকে। এক বস্তায় বড় আকারের পলিথিন থাকে ২০ হাজার। আর প্রতি বস্তায় ছোট পলিথিন থাকে আড়াই লাখ। বড় এবং ছোট মিলে চাক্তাই এবং সন্নিহিত অঞ্চলের গুদাম থেকে প্রতিমাসে গড়ে বিশ কোটি পলিথিন বাজারে আসছে। পরবর্তীতে এগুলো বাজার ঘুরে ক্রমে নদী ও নালা নর্দমা দখল করছে। সর্বশেষ গিয়ে জমছে কর্ণফুলীর তলদেশে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ পলিথিনের স্তর সৃষ্টি হওয়ায় কর্ণফুলীর ড্রেজিং কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এখনি পলিথিন বন্ধ করা না হলে পরিণতি আরো খারাপ হবে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নদীর তলদেশে উদ্ভিদ কণা ও প্রাণিকণা তৈরি হয়, এগুলো মাছ এবং অন্যান্য জীবের খাবার। কিন্তু নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর সৃষ্টি হলে মাটি উর্বরতা হারাবে, স্বাভাবিক খাদ্যচক্র নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এই অবস্থায় কেবল মাছই নয়, সব ধরণের জলজ জীবনের জন্য নদীতে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে।
চট্টগ্রামের পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক বিভাগীয় পরিচালক এবং বর্তমানে বন্দরের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ জাফর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টিকে খুবই উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, নদীর তলদেশে পানি যাওয়ার যেই প্রক্রিয়া তা এই পলিথিন স্তর নষ্ট করে দেবে। নদীর তলদেশের মাটির সাথে পানির একটি সম্পর্ক রয়েছে। অথচ পলিথিনের স্তর এখানে একটি স্থায়ী দেয়াল তৈরি করছে। এতে নদীর তলদেশের বিভিন্ন অনুজীবের খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে বলেও মোহাম্মদ জাফর আলম মন্তব্য করেছেন।