‘বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রত্যাশা: সবার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ সুষম খাদ্য’
ড. মো. হুমায়ুন কবীর: প্রতি বছরের ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করা হয়। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠনের পর থেকে ১৯৭৯ সালে এর ২০ তম সাধারণ পরিষদের কনফারেন্সে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা- ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) গঠন করার তারিখটিকে পরবর্তীতে ১৯৭৯ সাল থেকে বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি), ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলাপমেন্ট (আইএফএডি-ইফাদ) গঠন করা হয়েছে। পরবর্তীতে ইটালির রোমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এফএও’র সদর দপ্তর। প্রতিবছর দিবসটি পালনের জন্য সময়োপযোগী একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ইংরেজিতে জলবায়ু পরিবর্তন কৃষিতে একটি মারাত্মক অশনিসংকেত।
পৃথিবীর জনসখ্যা ক্রমবর্ধমান। প্রতিমুহূর্তেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েই চলছে। একসময় গাণিতিক এবং এখন জ্যামিতিক হারে বাড়তে বাড়তে বিশ্বের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০০ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিয়ে ক্ষুধার জ্বালা মেটানোই যখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ যখন আবার কৃষিতে উন্নততর প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অনেকাংশেই মেটানোর দ্বারপ্রান্তে। ঠিক তখনই জলবায়ু পরিবর্তনের মতো দৈব দানব এসে বাসা বেঁধেছে বিশ্বব্রহ্মা-ে।
আমরা সকলেই জানি বিশ্বকে আধুনিক ও আরামদায়ক করার জন্য দ্রুত নগরায়ন, শিল্পায়ন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের জন্য সৃষ্টি করছে বাড়তি সমস্যা। আর সেগুলো হলো বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণসহ সর্বোপরি সার্বিক পরিবেশ দূষণ। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত। কৃষিখাতের সাথে যেহেতু নাগরিক খাদ্য ও আহারের বিষয়টি জড়িত, সেজন্য যত বিপত্তি ও চিন্তা। সেটিকে গুরুত্ব দেওয়ার অংশ হিসেবেই গতবছর (২০১৫) ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ-২১) সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য বিশ্বের প্রায় দুই শতাধিক দেশ একমত হয়ে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। আশার কথা সেখানে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় থাকা ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশ অনুস্বাক্ষর করেছে ইতোমধ্যে। এই ৭০০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সবারই আর্থিক সঙ্গতি একরকম নহে। একেক মহাদেশে তা একেক রকম। সবচেয়ে ভালো অবস্থা হলো ইউরোপ ও আমেরিকায়। তারপর অস্ট্রেলিয়া। সেসব দেশের উদ্বৃত্ত খাদ্যের ইতিহাস খুবই ন্যাক্কারজনক। এমনও সময় গেছে যখন একদিকে কোন একটি দেশ তাদের নাগরিকদের খাওয়াতে পারছে না। তাদের না খেয়ে অস্তিচর্মসার দশা হয়েছে। অথচ সেসব তথাকথিত উন্নত দেশের উদ্বৃত্ত খাদ্য জাহাজ ভরে ভরে সাগরে ফেলে দিয়েছে। তখন যুদ্ধই ছিল ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি বড় মানদ-।
ধনী হোক অর গরীব হোক কোন একটি দেশ যদি অন্য একটি শক্তিধর দেশের পাশে অন্যায়ভাবে হলেও সমর্থন না জানাত তাহলে তাকে কেউই সাহায্য সহযোগিতা করতে চাইত না। এসব দেশ এখন দিনে দিনে আরো উন্নতি লাভ করেছে। সেজন্য বিশ্বব্যাপী তাদের কদরের সীমা নেই। এখানো ¯্রােতের মতোই মানুষ সুযোগে পেলেই সেখানে ছুটে যেতে চায়। এর একটি বড় প্রমাণ কিছুদিন আগেও দেখা গেছে। কারণ সেসব দেশে অভিবাসী হওয়ার জন্য অন্যান্য দেশ থেকে বানের জলে এমনকি জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে নৌকায় পর্যন্ত সাগর পাড়ি দিয়ে সেসব দেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। তবে খাদ্য পরিস্থিতির সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হলো আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশে। সেখানে এমন দেশও রয়েছে তাদের নাগরিকদের কারো বিদেশি সাহায্য ছাড়া দুবেলা দুমুঠো খাবার ভাগ্যে জুটে না। আবার এমন দেশও রয়েছে তারা এখন আর কৃষিকাজে লাভ কম হওয়ায় সেকাজে উৎসাহবোধ করে না। কৃষির পরিবর্তে তারা অন্যান্য লাভজনক ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশিবেশি বিনিয়োগ করছে। আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির ওপরে। এত বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে অন্ন প্রদানের জন্য যত কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে হলো অন্ন। তাইতো কবির কবিতায় বেজে উঠে, ‘জোটে যদি একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষধারও লাগি, জোটে যদি দুটো পয়সা ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী’। কারণ বাঁচতে হলে খেতে হবে। খাওয়া ছাড়া একজন মানুষের সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। তার বেশি নয়। মানুষের খাবারের মধ্যে ছয়টি উপাদান অপরিহার্য। আমিষ, শর্করা, ¯েœহ, খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি- এ ছয়টি খাদ্যোপাদান সমৃদ্ধ খাবারকে আদর্শ বা সুষম খাবার বলা হয়ে থাকে। এসব উপাদানের বেশিরভাগই রয়েছে ডিম ও দুধের মধ্যে। সেজন্যই ডিম ও দুধকে প্রাকৃতিক সুষম খাদ্য বলা হয়। খাবারের মধ্যে দানাদার-অদানাদার, শাক-সবজি, ডালজাতীয়, তেলজাতীয় আমিষ-নিরামিষ সব ধরনের খাবারই থাকতে হয়। চাল, গম, আটা, যব, আলু ইত্যাদি হলো দানাদার খাবারের প্রধান উৎস। একেক দেশের প্রধান খাদ্য একেকটি। কোন কোন দেশের প্রধান খাদ্য ভাত, কোনটির গম আবার কোনটির আলু।
যাই হোক না কেন দিনে তিনবেলা খাবার খাওয়া মানুষের সহজাত ধর্ম। কিন্তু সেই একদিনের মধ্যে কোন লোক কতবারের খাবার জুটাতে পারে তার উপর সেই লোকের সঙ্গতি কিংবা অসঙ্গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়। কোন সভ্য সমাজে প্রত্যেকটি নাগরিকেরই দিনে তিনবেলা খাবার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেটা যদি না পায় তখনই সেই লোকটি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বিশ্বে মোটা ভাত মোটা রুটি খেতে পায়না এমন লোকের সংখ্যা প্রচুর। যেখানে মোট ভাত কিংবা রুটিও ঠিকমতো জুটে না, সেখানে পুষ্টি কিংবা আদর্শ, সৃষম খাবারের কথা বলা বাহুল্যই মাত্র। এখানো মাত্র দিনে একবারও অনেক আবালবৃদ্ধবণিতা রয়েছে যারা দিনে একবেলাও ঠিকমতো কাবার খেতে পায়না।
যেকেউই ঢাকা শহরে ভালো করে চোখ মেলে ধরলেই দেখতে পাবে একমুঠো খাবার সংগ্রহের জন্য কোন টোকাই বা বস্তির শিশুরা সারাদিন ময়লার ডাস্টবিন কিংবা ভাগারে পড়ে আছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে এক টুকরো খাবার। এ চিত্র যে শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায় এমনটি নয়। সারাবিশ্বেই রয়েছে। এরা সবাই চরম দরিদ্র এবং এরা দ্রারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। আশা এবং স্বস্তির কথা এই যে, যারা একসময় সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল, তাদের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংকই সম্প্রতি (অক্টোবর ২০১৬) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশংসা করে গেছেন।
তারা এও সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন যে, এদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা লোকের সংখ্যা কমতে কমতে এখন তা ১২.৯ শতাংেশে এসে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর পিছনে রযেছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সূচকের উন্নতির পাশাপাশি কৃষিতে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতি সাধন। আর কৃষির উন্নতির পিছনে রয়েছে সরকারে উদার কৃষিনীতি। কৃষকের সহজশর্তে ঋণপ্রাপ্তি, সহজ ও কমমূল্যে কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি, কৃষিতে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান, দ্রুত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষি বিজ্ঞানীদের যুগোপযোগী ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজিত প্রযুক্তি আবিষ্কার ও ব্যবহার, সর্বোপরি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকারি গৃহীত কার্যক্রম খাদ্যশস্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এসব অনুকুল পরিবেশের কারণে এখন আমরা দেশে প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারছি। সেজন্য দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন আমরা কিছু পরিমাণ বিদেশে রপ্তানিও করছি। তবে এখন অন্যান্য ফসল যেমন- ডাল, তেল, আদা, পিয়াজ, রসুন ইত্যাদিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্ব বিষয়টি হলো নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান করা। কারণ এখন খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণের প্রত্যেকটি ধাপেই খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হয়ে থাকে। যে কোন রাসায়নিক মানেই বিষ। এসব বিষযুক্তখাবার খেয়ে প্রতিমুহূর্তেই আমরা ক্যানসারসহ নানা জটিল দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছি। কাজেই সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাবার প্রাপ্তিই হোক এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রত্যাশা।
লেখক: ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
কৃপ্র/ এম ইসলাম