কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ হেমন্তেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্র মরা নদীতে রূপ নিয়েছে। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মিলিত প্রবাহের বিশাল জলরাশি বুকে ধারণ করে বয়ে চলা যমুনা নদীতে জেগে উঠছে অসংখ্য বিশাল বিশাল চর। ভারত থেকে আসা ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ একসঙ্গে ধারণ করে যমুনা নদী বিশাল জলরাশি নিয়ে বির্স্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান ছিল। কিন্তু ভারত তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্রে নদে বহুসংখ্যক জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ফলে যমুনা নদীতে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ইতোমধ্যে যমুনা নদীতে পানির প্রবাহ কমে গেছে। নদীর বুক ভরাট হয়ে অসংখ্য বিশাল বিশাল চর জেগে উঠছে।
হিমালয় পর্বতমালার উৎস থেকে যে কয়টি দেশ পানির বিপুল সম্ভার লাভ করে থাকে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এসব নদীর প্রবাহ সরাসরি বাংলাদেশ পেতে পারে না। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীর সংখ্যা ৫৪টি। ভারত সবক’টি নদী ও উপনদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ভারত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা ও মহানন্দাসহ হিমালয় অঞ্চলের অভিন্ন নদী ও উপনদীতে ভারতে ৪৫০টি, নেপালে ৩০টি ও ভূটানে ২০টি বাঁধ নির্মান করেছে। প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে এসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে ভাটির বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে চীন ইয়াংগুন স্যাংগো প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্রের প্রায় পুরো পানি প্রত্যাহার করে তার উত্তরাঞ্চলের গোরী মরুভূমিকে শস্য-শ্যামলা করার পরিকল্পনা করেছে। তারা ইয়াংগুন স্যাংগো প্রকল্পের সাহায়্যে প্রায় ৮০ হাজার মেগাওয়াট পানিবিদ্যু উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। ইতোমধ্যে চীন একটি বিশাল ড্যাম নির্মাণ করে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে। তারা এরকম আরো ১০টি ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইয়াংগুন স্যাংগো প্রকল্প সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে ভাটিতে ব্রহ্মপুত্র নদের পুরো অববাহিকা এক সময় মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারত ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে যে সকল প্রকল্প গড়ে তুলেছে এরমধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র দু’টি নদী অববাহিকায় পানির ৩৩টি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করবে। প্রতিটি সঞ্চয়াগারের পানি ধারণ ক্ষমতা হবে এক লাখ ৫০ হাজার কিউসেক। এ পানি ভারতের পূর্ব, মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। এর আওতায় থাকবে তিন কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমি। পাশাপাশি উৎপাদন করা হবে ৩০ হাজার মেগাওয়াট পানিবিদ্যুৎ। সব মিলে খরচ হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁধসমূহের সাথে ৩৩টি সঞ্চয়াগার প্রতিস্থাপন করা হবে। স্থাপিত বাঁধের মাধ্যমে ভারত ৩৫ লাখ কিউসেক পানি ধরে রেখেছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত এসব সঞ্চয়াগারের মাধ্যমে ধরে রাখতে সক্ষম হবে ৫০ লাখ কিউসেক পানি। বাড়তি ১৫ লাখ কিউসেক পানির ঘাটতি বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ভারত গজলডোবার পর পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে তিস্তা নদীতে আরেকটি সেচ ও বিদ্যুৎ উপাদন প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে। একই নদীতে তারা এরকম আরো চারটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। ভারত তার অংশের তিস্তা নদীতে ৩১টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে তারা আগামী ১০ বছরে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ সম্প্রসারণ করবে। এই প্রকল্পের ফলে তিস্তা নদীর ভাটিতে পানি প্রবাহ আরো হ্রাস পাবে। এতে বাংলাদেশ অংশে পানি সঙ্কট বৃদ্ধি পাবে।
জানা যায়, ভারত তিস্তার তার অংশের পুরোটা কাজে লাগিয়ে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল প্রকল্প গ্রহন করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় পানির বড় বড় রির্জাভার গড়ে তোলা হবে। এগুলোর শক্তিশালী প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। অন্যদিকে তিস্তার ভারত অংশের একেবারে ভাটিতে বাংলাদেশের কাছে ব্যারেজ নির্মাণ ও ডাইভারশন খাল কেটে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলার নয় লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ দেয়ার জন্য ভারতের বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তার উজানে ভারত ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে ফেলেছে। আরো প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় তিস্তার ভাটিতে পানির প্রবাহ আরো কমবে। বাংলাদেশ অংশে বাড়বে পানি সঙ্কট। তিস্তায় পানি প্রবাহ কমার কারণে ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়ি তিস্তাসহ যমুনা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাবে। রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে। অন্যদিকে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্পে ফসল আবাদ ব্যহত হবে। সেচ প্রকল্প এলাকায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর শুস্ক মওসুমে পানির তীব্র সঙ্কট বিরাজ করে। এ কারণে গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে হচ্ছে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে ক্রমাগত পঙ্গু করে দিচ্ছে।
সুত্রঃ নয়াদিগন্ত / কৃপ্র/ এম ইসলাম