কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ নুন আনতে পানতা ফুরায়, এমন অভাবের সংসারে সাত কন্যা নিয়ে বিপাকে ছিলেন আবদুল হালিম। সে কারণে দারিদ্র্যের ধকল সইতে না পেরে, অষ্টম শ্রেণী পড়–য়া মেয়ে আয়েশা বেগমকে তুলে দেন পাশের বাড়ির বেকার ছেলের হাতে। হতদরিদ্র স্বামীর সংসারে আরো বেশি দারিদ্র্যের মুখোমুখী হতে হয় আয়েশার। তবুও দারিদ্র্যের কাছে হার না মেনে কিশোরী বধূ আয়েশা স্বামীর সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে নেমেছিলেন জীবনযুদ্ধে। কঠোর শ্রম ও মেধায় জয় করেন দারিদ্র্র্র্যকে। বর্তমানে বুটিকের কাজ করে আয়েশা শুধু তার নিজেরই ভাগ্য বদল করেননি। তার দেখানো পথে চলে, সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে চরাঞ্চলের সাড়ে তিন শতাধিক হতদরিদ্র নারীর। আয়েশা বেগম নামের ২৮ বছর বয়সী এ অদম্য মেধাবী নারীর বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তরবংশী ইউনিয়নের চরবংশী গ্রামে।
আয়েশার ভাষ্যমতে, ১৯৯৯ সালে বিয়ের কয়েক মাস পরেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের টিউশনির মাধ্যমে শুরু তার জীবন সংগ্রামের। একপর্যায়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে চাকরি নেন গার্মেন্টে। ২০০৫ সালে ঢাকায় একটি কারখানায় বুটিকের কাজ শিখেন। তখন তার মাসিক বেতন ছিল ১৫শ’ টাকা। পরে ২০০৬ সালে লক্ষ্মীপুরে নিজ গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেন বুটিক শাড়ি তৈরীর ছোট কারখানা। মিউচ্যুয়াল ষ্ট্রাট ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে ঋণ নেন ৩ লাখ টাকা।
চরাঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হতদরিদ্র প্রায় ৪ শতাধিক নারীকে শিখিয়ে দেন শাড়িতে বুটিকের কাজ। ৫টি ফ্রেম নিয়ে কারখানা শুরু হলেও এখন তার শাড়ি তৈরীর ৮৫টি ফ্রেম রয়েছে। তার অধিনে বর্তমানে বুটিকের কাজ করছেন সাড়ে ৩ শতাধিকের বেশি নারী। এদের অধিকাংশ সাংসারিক কাজের অবসরে ঘরে বসেই বুটিকের কাজ করে প্রতি মাসে জনপ্রতি দুই হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন।
এসব নারী কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি কারুকার্য খচিত বুটিকের তৈরী শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ঢাকা, চট্রগ্রামে। আয়েশা নিজেই ঢাকা বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স, নিউ মার্কেট, হকার্স মার্কেট, গাউছিয়া ও চাঁদনী চকে এসব শাড়ি পাইকারী দরে বিক্রি করছেন।
আয়েশার বুটিক কারখানার সুপারভাইজর রোজিনা আক্তার জানান, তার মতো চরাঞ্চলের অসংখ্য অবহেলিত হতদরিদ্র নারী আয়েশার শেখানো বুটিকের কাজ করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে অবদান রাখছেন। একটি শাড়িতে বুটিকের কাজ সম্পন্ন করতে ৫ জন নারীর ৮থেকে ১০ দিন সময় লাগে। একটি শাড়ি বুনতে খরচ হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা।
সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরানোর কাজেই থেমে থাকেননি আয়েশা। ২০০৫ সালে আবারও স্কুলে ভর্তি হন। পরে এসএসসি এইচএসসি উর্ত্তীণের পর ২০১৪ সালে লক্ষ্মীপুর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বর্তমানে লক্ষ্মীপুরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নার্সিং কোর্সে ডিপ্লোমা করছেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জননী আয়েশা তার উপার্জনের টাকায় দু’ বছর আগে স্বামীকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। তার ৬ বোনের ৩ জনকে বিয়ে দিয়েছেন ও ৩জন কলেজে পড়ছেন। তিনি তাদের পড়াশুনার খরচ বহন করছেন।
চরাঞ্চলের অবহেলিত হতদরিদ্র নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে সফল এ নারী উদ্যোক্ত্যা ২০১৪ সালে উপজেলা, জেলা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ সম্মাননা লাভ করেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা পেলে বিপুল সংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি আরো গতিশীল হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আয়েশা বেগম জানান, প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৫০হাজার টাকা আয় হচ্ছে তার। সাড়ে ৩ শতাধিক নারীর প্রত্যেকের মাসে ২ থেকে ৭ হাজার টাকার বেশী আয় হচ্ছে। গ্রামের অবহেলিত হতদরিদ্র নারীদের বিশাল জনগোষ্ঠির ভাগ্যবদলের স্বপ্ন দেখেন তিনি। সেজন্য সরকারের ও বিত্তশালীদেরর পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা কামনা করছেন তিনি।
সুত্রঃ বাসস / কৃপ্র/ এম ইসলাম