কৃষি প্রতিক্ষণ রিপোর্টঃ রাজধানী ঢাকার ওয়ারী ও এর আশপাশের স্থানকে একসময় মানুষ অভিজাত এলাকা হিসাবে জানত । আর এ অভিজাত এলাকার আভিজাত্য অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছিল ওয়ারীর শত বছরেরও বেশি পুরনো অপরূপ ‘বলধা গার্ডেন’ বা বোটানিক্যাল গার্ডেন। ৩.১৫ একর জমির ওপর এ বলধা গার্ডেন রয়েছে নতুন-পুরনো বাহারি নানা ধরনের গাছপালা। একে উদ্ভিদের জাদুঘরও বলা হয়ে থাকে। রাজধানীতে গর্ব করার মতো যতগুলো গার্ডেন বা দর্শনীয় স্থান তার মধ্যে অন্যতম ছিল এ বলধা গার্ডেন।
এটি প্রায় ১০৬ বছরের পুরনো এ বলধা গার্ডেন রয়েছে দেশী-বিদেশী নানা দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতা গুল্ম।এ বাগানে সব মিলিয়ে ৯৫০টি দুর্লভ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৮০০ শতাধিক সুস্থ থাকলেও ১৫০টি গাছের অবস্থা যেনতেন। সাইকি বলধারই অপর একটি অংশ এখানেও রয়েছে দুর্লভ অনেক গাছ। সাইকি অংশটি বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে।ফলে বৃক্ষ বা প্রকৃতিপ্রেমিকরা খোলা অংশেই প্রবেশ করেন। কয়েকজন দর্শনার্থী বললেন, ‘যখন বলধা গার্ডেনের দু’টি অংশ দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকত তখন বেশি ভালো লাগত। শিশুরাও বেশ আনন্দ পেত।
সাইকি অংশ বন্ধ রাখার কারণে এর প্রতি দর্শনার্থীদের যেন কৌতূহল বেড়েছে। অনেকে মনে করেন, এর ভেতরটা না জানি কেমন, কেমন ধরনের উদ্ভিদই না আছে। অনেকে তাই বলেন, ফের বর্ধিত বা সাইকি অংশটিও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে আরো ভালো হয়। তাতে তাদের আনাগোনাও বাড়বে। তবে উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকি অংশ বিশেষ অনুমতির মাধ্যমে অল্প সময়ের জন্য খুলে দেয়া হয়। নানা রঙের শাপলা, দেশী-বিদেশী ক্যাকটাস, অ্যানথুরিয়াম, অর্কিড, বকুল, ভূর্জপত্র প্রভৃতি ছিল সাইকি অংশের প্রধান বা বিশেষ আকর্ষণ। ছিল মিসরীয় প্যাপিরাসও। আকর্ষণীয় নানা উদ্ভিদের ভাণ্ডার ছিল বলেই একসময় বলধা গার্ডেনকে বলা হতো ‘উদ্ভিদের জাদুঘর’।
কালের বিবর্তনে অনেক গাছ মরে গেছে। তার পরও বলধা গার্ডেনকে কেবলই বাগান বা উদ্যান ভাবা যাবে না। আগেই বলা হয়েছে, এটি উদ্ভিদ জাদুঘর। এ গার্ডেন গড়ে তোলা হয়েছিল ১৯০৯ সালে মানুষের অবকাশ যাপনের জন্য। এ বাগানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটি জাদুঘর ও একটি গ্রন্থাগার। ১৯৪৩ সালের দিকে বলধা গার্ডেন পরিচালিত হতো কলকাতা হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণে একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে। পরে এর দেখভালের ভার যায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ওপর। এরই ধারাবাহিকতায় বাগানটির দায়িত্ব বর্তায় পাকিস্তান সরকারের বন বিভাগের ওপর ১৯৬২ সালে। আর এখন বাংলাদেশ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের একটি স্যাটেলাইট ইউনিট এটি। এর প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। তিনি ছিলেন জমিদার বা ল্যান্ডলর্ড। তার মৃত্যুর পর তার বড় পুত্র এ বাগান সরকারের হাতে তুলে দেন। এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শনও।
নানা অব্যবস্থাপনার কারণে ক্রমেই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে বলধা গার্ডেন। নানা কারণে রুচিশীল দর্শনার্থীরাও খুব একটা আসতে চান না এখানে। বলধার চার পাশে প্রচুর হাইরাইজ বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। তাতে দুপুরেও খুব একটা আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে না এর ভেতরে। অনেক সময় বাইরে থেকে বর্জ্য পড়ে বাগানের ভেতর। বৃষ্টি হলে এর ভেতর পানি জমে থাকে। এসব কারণে দুর্লভ পুরনো অনেক গাছ মরে গেছে। মরে যাওয়া অনেক ধরনের গাছ ফের পাওয়া কঠিন বলে জানিয়েছেন বাগান পরিচর্যাকারীরা।
তবে উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে ভবিষ্যতে মরে যেতে পারে, এমন গাছ বাঁচানো সম্ভব। এসব প্রজাতির গাছের চারা বা কলম অন্যত্র নিয়ে লাগাতে হবে। তবে খুশির খবরও আছে। জানা গেছে, ঢাকার কাছাকাছি জমি খোঁজা হচ্ছে দ্বিতীয় বলধা গার্ডেন গড়ে তোলার জন্য। আর তা করা হবে বিদেশী ভালো মানের বাগানের আদলে।
গার্ডেনের দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের ফরেস্টার বশির আহমেদ বলেন, সংকটের মধ্যেও আমরা মূল্যবান গাছ গাছালি সুস্থ রাখছি। ৮০০-এর বেশি প্রজাতির গাছ এখনো সুস্থ রয়েছে। এদিকে বলধা গার্ডেনের বিরল উদ্ভিদ সংরক্ষণে মূল বাগান ঠিক রেখে এর আদলে আরও একটি বলধা গার্ডেন তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন উদ্ভিদতত্ত্ববিদ ও গবেষক মোকারম হোসেন। তিনি বলেন, বাগানটির বর্তমানে যে অবস্থা সেটি থেকে বের করে সমৃদ্ধ উদ্ভিদ প্রজাতিকে বাঁচাতে হলে এর আদলেই আরও একটি বাগান তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া প্রধান প্রধান গাছগুলো অক্ষত রেখে এবং বর্তমান বাগানকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে চারা-কলমের মাধ্যমে বাগানের গাছগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বলধা গার্ডেনের আদলে আরেকটি বাগান তৈরি করা যাবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম