কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ঝালকাঠির গাবখান চ্যানেলের নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালের সঙ্গে খুলনা, মংলা, মোরেলগঞ্জ, হুলারহাটসহ বিভিন্ন নৌবন্দরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে নৌপথনির্ভর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তবে চ্যানেলের নাব্য সংকট-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।
নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ-ভারত নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় দেশের যে তিনটি প্রথম শ্রেণীর আন্তর্জাতিক নৌরুট চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে গাবখান চ্যানেল একটি। ঝালকাঠির সুগন্ধা-বিষখালীর সঙ্গে পিরোজপুরের সন্ধ্যা নদীর সংযোগ ঘটিয়েছে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ চ্যানেল। একসময় সুগন্ধা থেকে ধানসিঁড়ি নদী হয়ে সন্ধ্যা নদী দিয়ে চলাচল করত ঢাকা, চট্টগ্রাম, ভারতের আসাম ও কলকাতাসহ বিভিন্ন রুটের নৌযানগুলো। এতে অর্থ ও সময় বেশি লাগত। এ সমস্যা সমাধানে ঝালকাঠি অংশে প্রায় ১০ কিলোমিটার নদী খনন করে সুগন্ধা-বিষখালীর সঙ্গে পিরোজপুরের সন্ধ্যা নদীর সংযোগ ঘটানোর মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালের সঙ্গে খুলনা, মংলা, মোরেলগঞ্জ, হুলারহাটসহ গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দরগুলোর দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার কমিয়ে আনা হয়।
কিন্তু দীর্ঘদিন ড্রেজিং না করায় চ্যানেলটির নাব্যতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে, সেই সঙ্গে সুগন্ধা-বিষখালী-গাবখানের মোহনাসহ বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। ফলে ভাটার সময় এ চ্যানেল দিয়ে ১০ ফুট ড্রাফটের নৌযানও চলাচল করতে পারে না, অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য। এছাড়া বড় নৌযানগুলোও প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেশি পথ ঘুরে বঙ্গোপসাগর হয়ে চলাচল করে। মাঝারি আকৃতির নৌযানগুলো জোয়ারের সময়ও অত্যন্ত ধীরগতিতে এ চ্যানেল অতিক্রম করে। এছাড়া চ্যানেলটির আকৃতি ছোট হওয়ায় এক প্রান্ত দিয়ে নৌযান প্রবেশ করলে অন্যপ্রান্তে নৌযান আটকে রাখতে হয়। অথচ আগে চ্যানেলের দুই দিক থেকেই বড় আকারের নৌযান একই সময়ে নিরাপদে চলাচল করতে পারত। বর্তমানে চ্যানেলটিকে ওয়ান ওয়ে সিগনালিং ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু চালকরা এ সিগনালিং ব্যবস্থা না মানায় নাব্যতা ও প্রশস্ততা সংকটের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চ্যানেলের এক টোল আদায়কারী বলেন, ‘গত আট বছরে চ্যানেলটি ড্রেজিং না হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র আন্তর্জাতিক নৌপথটি এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। যদিও কাগজে কলমে এরই মধ্যে ছোটখাটো সংস্কার ও খননকাজ দেখিয়ে কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এসব কাজে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা জড়িত বলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না।’
বিআইডব্লিউটিএর খনন বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে চ্যানেলটির এক লাখ ঘনমিটার চর খনন করা হয়। এর আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দুই লাখ ঘনমিটার খনন করা হয়েছিল। চ্যানেলটির নাব্য সংকট দূর করতে ও প্রশস্ততা বাড়াতে বড় বাজেটের প্রয়োজন। যার জন্য আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ প্রকল্পের আওতায় কাজ করে চ্যানেলটিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। এছাড়া চ্যানেলটির সুগন্ধা মোহনা এবং পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর উত্তর প্রান্তে চর জেগে ভয়াবহ নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রশস্ততা ২৪০ ফুট থেকে কমে ১০০ থেকে ১২০ ফুটে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল মালিক সমিতির নির্বাহী সদস্য মো. ইউনুস বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ গাবখান চ্যানেল থেকে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে ৮ টাকা হারে টোল আদায় করে। সে হিসাবে চ্যানেলটি থেকে বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা আয় হয়। কিন্তু চ্যানেলটি খননে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘চ্যানেল দিয়ে এখন এক হাজার টনের বেশি পণ্যবোঝাই কোনো নৌযান চলাচল করতে পারছে না। ডুবোচর জেগে ওঠায় এবং বিভিন্ন পয়েন্টে প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় চ্যানেলটি এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভাটার সময় চ্যানেলে সর্বোচ্চ ৭ ফুট এবং জোয়ারের সময় ৯-১০ ফুট পানি থাকে। কিন্তু নিরাপদ জাহাজ চলাচলের জন্য ১২-১৫ ফুট পানি থাকা প্রয়োজন। নাব্যতা কমে যাওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।’
বিআইডব্লিউটিএর যাত্রীবাহী জাহাজের চালক আতাউর রহমান বলেন, ‘ঝালকাঠি প্রান্ত থেকে চ্যানেলে ঢুকতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। সারেঙ্গল, শেখেরহাট, মাজার পয়েন্টসহ চারটি টার্নিং পয়েন্ট খুবই বিপজ্জনক। এ কারণে খনন ও প্রশস্ততা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। বিকল্প পথ না থাকায় অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে চ্যানেল দিয়ে যাতায়াত করেন।’
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ বন্দর ও পরিবহন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গাবখান চ্যানেলটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে চ্যানেলের নাব্যতা সংকট-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো যাচ্ছে না।’
এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে চ্যানেলের ইজারাদার খান সাইফুল্লা পনীর বলেন, ‘চ্যানেলটি ড্রেজিংয়ের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন জানিয়ে লাভ হয়নি। গত বছর ড্রেজিং শুরু করেও অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। নাব্য সংকটের কারণে চ্যানেল দিয়ে নৌাযান চলাচল আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এখন ইজারার টাকা ওঠানো নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।’
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম