কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বর্তমানে এক মণ ধান উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ হয় ৬৫০ টাকা। কিন্তু বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৪০০’ থেকে ৪৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মণ ধানে কৃষকের ২০০ লোকসান টাকা। এ কারণে কৃষক ধানের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষ করছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আগামীতে তা বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এ অবস্থা উত্তরণে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আধুনিক যন্ত্র কেনায় কৃষককে ভর্তুকি দিতে হবে। এ জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া জরুরি। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ এসব কথা বলেন।
মাঠপর্যায়ে গবেষণার একটি তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফসলের বহুমুখীকরণ হচ্ছে। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষক ধান ছেড়ে অন্য ফসল চাষ করছে। এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর সমাধান হচ্ছে দুটি। প্রথমত- ধানের মূল্য বাড়াতে হবে। অর্থাৎ সরকারকে আরও বেশি দামে ধান কিনতে হবে। কিন্তু এটি সম্ভব নয়। সরকার বেশি দামে ধান কিনলে দেশে চালের দাম বাড়বে। এতে ভারতীয় চালে আমাদের বাজার দখল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কোনোভাবেই এটি ঠেকানো যাবে না। অর্থাৎ দাম বাড়ানোর অর্থনৈতিক কাঠামোতে আমরা নেই। দ্বিতীয়ত- ভর্তুকি বাড়ানো যেতে পারে। তবে ভর্তুকির ধরন পরিবর্তন করা জরুরি। যন্ত্র কেনায় কৃষককে ভর্তুকি দিতে হবে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক বলেন, কৃষিতে তিন ধরনের আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার হয়-জমি চাষ, চারা রোপণ এবং ধান কাটা। জমি চাষে ৮০ শতাংশ কৃষক ট্রাক্টর বা কলের লাঙ্গল ব্যবহার করে। কিন্তু চারা রোপণ ও ধান কাটায় যন্ত্রের ব্যবহার ১ শতাংশেরও কম। আর এ যন্ত্র সহজলভ্যও নয়। তাই এ খাতে ব্যাংক ঋণসহ সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়া উচিত।
প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে মানুষ বেকার হয়ে যাবে-এমন ধারণা ঠিক নয় উল্লেখ করে শাইখ সিরাজ বলেন, বর্তমানে এলাকায় কাজের লোক পাওয়া যায় না। দেশে নিজস্ব উদ্যোগে প্রচুর শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সব জায়গায়ই জনবলের সংকট। তিনি বলেন, ধান কাটা ও চারা রোপণের মৌসুমে কাজের লোক পাওয়া যায় না। কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে একদিকে খরচ কমে, অন্যদিকে স্বল্প সময়ে চারা রোপণ করা যায়।
শাইখ সিরাজ আরও বলেন, দেশের ৬টি জেলা হাওর অঞ্চল হিসেবে খ্যাত। এগুলো হচ্ছে বৃহত্তর সিলেট ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া। গত কয়েক বছর এই ৬ জেলায় চোখের সামনে বন্যায় ফসল নিয়ে যায়, কিন্তু কৃষকের কিছু করার থাকে না। ফলে সরকারকে এসব জেলার জন্য একেবারে সহজ শর্তে ফসল কাটার যন্ত্র দিতে হবে। তিনি বলেন, বাঁধ দিয়ে হাওরের ফসল রক্ষা করা যাবে না। কারণ বাস্তবতা হল সরকারের এত টাকা নেই। ফলে দ্রুত কীভাবে ফসল ঘরে নেয়া যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
গত বছর দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকার পরও ভারত থেকে কেন চাল আমদানি করা হল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে কৃষিতে জাতিসংঘের এএইচ বুর্মা অ্যাওয়াড জয়ী এই গবেষকের। তার মতে, সরকার বিপুল অংকের কৃষিঋণ বিতরণ করে। কিন্তু প্রকৃত কৃষকরা এই ঋণ পায় না। ফলে বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষকরা দাবি করেছেন, কৃষি ঋণ প্রাপ্তদের তালিকা ব্যাংকের সামনে টানাতে হবে। এতে কারা ঋণ পেল তা বোঝা যাবে।
প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে বলেই দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে মন্তব্য করে এই উন্নয়ন গবেষক বলেন, প্রযুক্তির কারণে কম জমিতে চাষাবাদ করে বেশি ফসল পাওয়া যাচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তির কারণে আমাদের ফসলের সম্প্রসারণ পদ্ধতি হরাইজেন্টাল থেকে ভার্টিকাল পদ্ধতিতে বিকাশ হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যে গতিতে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, সে গতিতে প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে যাচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রযুক্তি বলতে সহজে আমি বুঝি, কৃষকের কাছে এমন একটি উপাদান দেয়া যা ব্যবহার করে সে নিজেও লাভবান হল এবং দেশও উপকৃত হল। বিতর্ক হচ্ছে- পরিবেশ ঠিক রেখে এটি করা যায় কিনা। পরিবেশ ঠিক রেখে এটি করতে পারলেই প্রযুক্তির সফলতা।
শিল্পায়নের কারণে ধনীদের চেয়ে দরিদ্র দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে শাইখ সিরাজ বলেন, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় হিমালয় পর্বতসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে আমাদের উপকূল এলাকা বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় উপর্যুপরি বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। শুকনো দিনে গরমের তীব্রতা এত বেশি যে, জমি শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভোগ করছে উন্নত দেশ। কিন্তু মূল্য দিচ্ছি আমরা। তিনি বলেন, সমস্যাগুলোকে মাথায় নিয়ে আগামীতে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে।
সার্বিকভাবে কৃষি খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল জলবায়ু পরিবর্তন- এমন মন্তব্য করে এই অশোকা ফেলো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গরমের মৌসুমে প্রচণ্ড গরম এবং শীতের সময়ে শীত থাকে ক্ষণস্থায়ী। উত্তরাঞ্চলে প্রচণ্ড খরা দেখা দিচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে রাজশাহীর অবস্থা হবে ভয়াবহ। এছাড়াও হঠাৎ উপর্যুপরি বন্যা এবং ক্রমশ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পানি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের কৃষকরা এই বৈরী পরিবেশের সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নয়। এর ফলে আগে জমিতে যে ফসল উৎপাদিত হতো এখন ওই ফসল উৎপাদিত হয় না। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, দেশে ১০ লাখ হেক্টর লবণাক্ত জমি রয়েছে। প্রতিবছরই এ লবণাক্ততা বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা বলছে, ১৬ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ত জমিতেও ফসল ফলানো হয়তো বা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ওই ফসলের মধ্যে খাদ্যের উপাদান হারিয়ে যাবে। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ। এসব সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে শাইখ সিরাজ বলেন, সবার আগে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কোন এলাকার জমিতে কী ফসল ভালো হবে, কী ধরনের বীজ ব্যবহার করতে হবে তা গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি গবেষণায় বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম