কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সুন্দরবনের বাঘ হত্যায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়। এই চক্র সুন্দরবনে বাঘ হত্যায় অস্ত্র সরবরাহ, হত্যা শেষে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও চামড়া চোরাচালানের সঙ্গে কাজ করে। সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার সরকারদলীয় একজন সাংসদ, ইউনিয়ন পরিষদের তিনজন চেয়ারম্যান এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বেশ কয়েকজন নেতা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত জানুয়ারি মাসে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুন্দরবনের বাঘ হত্যা এবং ক্ষুদ্র অস্ত্রের সরবরাহ নিয়ে দুটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সুন্দরবন থেকে বাঘ হত্যা করে এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভারতে পাচার করা হয়। এই পাচারের সঙ্গে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন দুটি তৈরি করতে ইন্টারপোল ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করেছে। মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন এবং স্থানীয় পর্যায়ের তথ্য থেকে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন। বাংলাদেশ ও ভারতের ইন্টারপোল সমন্বয়কদের কাছে প্রতিবেদন দুটি জমা দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বাঘ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা কমে ১০৬টিতে দাঁড়িয়েছে।
ইন্টারপোলের প্রতিবেদনে বাঘ হত্যা এবং ডাকাত দলগুলোকে অস্ত্র সরবরাহকারী ৩২ ব্যক্তির নাম এবং বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকায় সাতক্ষীরা-৪ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাংসদ এস এম জগলুল হায়দারের নাম উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সেখানে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলী আজম ওরফে টিটু, একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মাসুদুল আলম, রমজাননগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আকবর আলী গাজীর নাম রয়েছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ থেকে বাঘ চোরাচালান করে ভারতে পাচারের সঙ্গে গিরেন বিশ্বাস, গোলজার ও নিখিল নামের তিনজন ভারতীয় চোরাচালানকারীকে চিহ্নিত করেছে ইন্টারপোল। এ ছাড়া বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী এবং বন বিভাগের চোরাচালানবিরোধী অভিযানের তথ্য ফাঁসকারী হিসেবে শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইন্টারপোলের প্রতিবেদনটি আমরা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছি। তারা অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।’ ইন্টারপোলের তালিকায় থাকা রমজাননগর ইউনিয়নের সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হামিদ ওরফে লালটু, হজরত শেখসহ মোট চারজনকে গত জুলাই মাসের ১৪ তারিখ র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব) আটক করে নিয়ে যায়। র্যা ব থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে থানায় সোপর্দ করার পর তাঁরা আবার ১১ জুলাই জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।
সরকারের কাছে দেওয়া ‘বাংলাদেশ সুন্দরবনে বাঘের বাণিজ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৭৬ শতাংশ কমে গেছে। পেশাদার বন্য প্রাণী শিকারি একটি চক্র বাঘ হত্যা করে তা ভারতে পাচার করছে। ভারত থেকে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোক বলেন, ‘বাঘ হত্যায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল জড়িত এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে মদদ দেওয়া হয়। এই কথা আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। আমরা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছি।’
কারা জড়িত: ইন্টারপোলের প্রতিবেদন অনুযায়ী সুন্দরবনকেন্দ্রিক ডাকাত দল রয়েছে ১৫ থেকে ২০টি। এরা সুন্দরবনে অবস্থান করে বন্য প্রাণী হত্যা, অবৈধ পণ্যের ব্যবসা, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা করে থাকে। মূলত এই ডাকাত দলের সদস্যরাই আগ্নেয়াস্ত্র ও বিষ-ফাঁদ দিয়ে বাঘ হত্যা করে থাকে। সুন্দরবন-সংলগ্ন একটি চক্র ওই বাঘের চামড়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়। আর এই দুই চক্রকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদদ দেয় আরেকটি চক্র। ইন্টারপোল থেকে এই তিন চক্রের সদস্য হিসেবে ৩২ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের তালিকায় থাকা চোরাচালান চক্রের সহযোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত আট ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। সাংসদ জগলুল হায়দারসহ প্রত্যেকেই তালিকায় তাঁদের নাম থাকাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে তাঁরা এ ধরনের কোনো তৎপরতায় জড়িত নন বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সাংসদ জগলুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের এমপিরা সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্যবসায় হস্তক্ষেপ করত। আমি সুন্দরবনের দিকে কখনো তাকাইনি। জেলে-বাওয়ালি-মৌয়ালি আর ফরেস্টের লোকদের জিজ্ঞেস করেন। তাঁরাই বলবেন আমি এগুলোর সঙ্গে নাই।’
ইন্টারপোলের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় নাগরিক গোলজার হোসেনের কাছে সাতক্ষীরার হজরত শেখ ২০১৪ সালে একটি বাঘের চামড়া বিক্রি করেন। অপর ভারতীয় নাগরিক নিখিল ২০১৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের মহসিন গাজীর কাছ থেকে বাঘের চামড়া কিনে নিয়ে যান। গোলজার হোসেনকে প্রতিবেদনে ভারতের কংগ্রেস দলের একজন সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে গোলজার ও হজরত শেখের যে মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। সাতক্ষীরা এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হজরত শেখ বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে।
তবে হজরত শেখের প্রধান সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হামিদ ওরফে লালটুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভুল করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন বলে লালটু দাবি করেন। গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি সভাপতি মাসুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মতো মানুষরে নিয়ে ইন্টারপোল যদি এসব তথ্য লেখে, তাহলে এই সংস্থার গ্রহণযোগ্যতাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাদের কথা আর কেউ বিশ্বাস করবে না।’
সাতক্ষীরার রমজাননগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আকবর আলী গাজীর নামও ডাকাত দলের মদদদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি উল্টো সুন্দরবনের বাঘশিকারি ও ডাকাতদের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করেছি। আমার বিপক্ষের রাজনৈতিক নেতারা এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন।’
কোথাকার বাঘ কোথায় যায়: ইন্টারপোলের প্রতিবেদন অনুযায়ী সুন্দরবনের বাঘ হত্যা করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির মূলত তিনটি বাজার ভারত, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া। এসব বাজার থেকে বাঘের চামড়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও পাচার হয়। দেশের ভেতরেও বাঘের হাড়, দাঁত, নখ ও মাংসের একটি অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঘ হত্যা করে ছোট্ট নৌকা ও স্পিডবোটে তা ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখানে ভারতীয় চোরাচালান চক্র তা কিনে নেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু সদস্য অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া সুন্দরবন থেকে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গাড়ি ও মোটরসাইকেল-যোগে ঢাকায় এনে সংরক্ষণ করার ঘটনাও ইন্টারপোলের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ থেকে চীন, মালয়েশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কাঁকড়া ও মাছের চালানের সঙ্গে লুকিয়ে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাঠানো হয় বলে ইন্টারপোলের প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে। আর এই চালানগুলো হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের বাঘ হত্যা ও চোরাচালান বন্ধে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছি। তারা চেষ্টাও করছে। তবে বাঘ চোরাচালান চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনলে বাঘ ও সুন্দরবন দুই-ই রক্ষা পাবে।
সুত্রঃ prothom-alo.com