কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সিম বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শীতকালীন সবজি। এর ইংরেজি নাম Bean ও বৈজ্ঞানিক নাম Lablab purpurcus. বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই কম বেশি সিম চাষ করা হয়। তবে নেত্রকোণা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী ইত্যাদি এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সিম চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। একজন বেকার নারী বা পুরুষ নিজের কর্মসংস্থান ব্যবস্থার জন্য নিজের জমিতে অথবা বর্গা নেয়া জমিতে সিম চাষ করে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
পুষ্টিগুণ: সিমে শর্করা, প্রোটিন এবং ভিটামিন বি ও সি আছে। এর পরিপক্ক বীজে প্রচুর আমিষ ও স্নেহ জাতীয় পদার্থ আছে।
বাজার সম্ভাবনাঃ সিম হচ্ছে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। ছোট বড় সবাই এই সবজি খেতে পছন্দ করে। সিম ভাজি, ভর্তা ও তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। সিমের বীচি শুকিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় এবং তা ভেজে খাওয়া যায়। যেহেতু সিমের চাহিদা সবার কাছেই আছে তাই সিম চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদন বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করা সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। সিম বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস (মধ্য জুন থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর) সিমের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি সিম চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ মাটিতে এর উৎপাদন ভালো হয়। ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়া এর ফলন ভালো হয়।
জাত
* বারি সিম-১
১. এই জাতটি ১৯৯৬ সালে চাষের জন্য অনুমোদন করা হয়।
২. সিমের রঙ সবুজ।
৩. প্রতিটি সিম ১০-১১ সে.মি. লম্বা ও ২.০-২.৫ সে.মি. চওড়া।
৪. প্রতিটি সিমের ওজন ১০-১১ গ্রাম।
৫. প্রতিটি সিমে ৪-৫টি বীজ হয়।
৬. প্রতি গাছে ৪৫০-৫০০টি সিম ধরে।
৭. সিম পাকার আগ পর্যন্ত নরম থাকে।
৮. এ জাতটি মাঝারি আগাম।
৯. এ জাতটির জীবনকাল ২০০-২২০ দিন।
১০. উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ৩ টন ফলন পাওয়া সম্ভব।
১১. এই জাতটি ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী।
বারি সিম-২
১. বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে উদ্ভাবিত এ জাতটি ১৯৯৬ সালে চাষের জন্য অনুমোদন করা হয়।
২. সিম সরু ও লম্বাটে, রং সবুজ।
৩. প্রতিটি সিম ১০-১৩ সে.মি লম্বা ও ১.৫-২ সে.মি. চওড়া।
৪. সিমের ওজন ৭-৮ গ্রাম।
৫. প্রতিটি সিমে ৪-৫টি বীজ হয়।
৬. প্রতি গাছে ৩৮০-৪০০টি সিম ধরে।
৭. পাকার আগ পর্যন্ত ফল নরম থাকে।
৮. এক মৌসুমে ১৫-১৬ বার সিম সংগ্রহ করা যায়।
৯. জীবনকাল ১৯০-২১০ দিন।
১০. উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ১.৫ টন ফলন পাওয়া যায়।
১১. এ জাতটি ভাইরাস রোগ প্রতিরোধী।
জমি তৈরি
১. সিম চাষের আগে জমি খুব ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। জমি ও মাটির অবস্থা বুঝে ৪-৬টি চাষ ও মই দিতে হবে।
২. বসত বাগানে সিম চাষ করতে হলে ৯০ সে.মি. চওড়া ও ২৫ সে.মি. গভীর করে ২-৩টি মাদা তৈরি করতে হবে।
৩. প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বপন করতে হবে।
৪. জমিতে চাষের সময় ২ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে।
বীজ বপন
১. প্রতি বেডে ২ থেকে ৩ মিটার দূরে দূরে মাদায় ৪-৫টি বীজ বপন করতে হবে।
২. বীজ কিছুটা গভীরতায় বপন করতে হবে। তাহলে বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হবে এবং পাখি বীজ নষ্ট করতে পারবে না।
সার প্রয়োগ
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে সিম চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশেপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ ও নিষ্কাশন
১. চাষের সময় জমিতে রসের অভাব হলে প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।
২. বীজ বপনের সময় বৃষ্টি থাকতে পারে। তাই গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
রোগ বালাই
জাব পোকা : বাদামী বা কালো রঙ এর খুব ছোট জাবপোকা প্রধানত: কচি গাছ বিশেষ করে কচি পাতা, ফুল এবং কচি শিমের রস শোষণ করে। প্রাপ্ত বয়স্ক জাবপোকার আক্রমণের ফলে সিমের গুটির বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং উৎপাদন কম হয়। জাবপোকা হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগ বিস্তারে সাহায্য করে।
জ্যাসিড পোকা : পূর্ণবয়স্ক জ্যাসিড পোকার গায়ের রঙ সবুজ এবং ২ মি.মি. লম্বা। পাতার নিচের দিকে জ্যাসিড পোকার নিম্ফ দলবদ্ধভাবে থাকে। প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক জ্যাসিড নিম্ফ গাছের কোষ থেকে রস শোষণ করে। জ্যাসিডের আক্রমণে প্রথমে পাতার কিনারা হলুদ রঙ ধারণ করে এবং পাতা কুঁচকে যায়।
ফল ছিদ্রকারী পোকা : এটি হচ্ছে নরম তুলতুলে বাদামী রঙ এর অতি ক্ষুদ্র আকারের এক ধরণের পোকা। প্রথমে এ পোকা সিমের উপরের অংশ খায়, পরে ফলছিদ্র করে এবং ভিতরের বীজসমূহ খায়।
থ্রিপস পোকা : এই পোকার আক্রমণে সিমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে। বিশেষত ভালো আবহাওয়ায় এই পোকা সিম গাছের ক্ষতিসাধন করে থাকে। পূর্ণাঙ্গ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক থ্রিপস পাতা থেকে রস চুষে খায়। পাতার মধ্য শিরার কাছাকাছি এলাকা বাদামী রঙ ধারণ করে ও শুকিয়ে যায়। নৌকার খোলের মতো পাতা উপরের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়। গাঢ় বাদামী রঙয়ের পূর্ণাঙ্গ থ্রিপস পোকা খুবই ছোট, সরু ও লম্বাকৃতির। খালি চোখে কোনমতে এদের দেখা যায়।
এনথ্রাকনোজ : বীজ বাহিত এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণে এনথ্রাকনোজ রোগ হয়। সিমের গায়ে কালো দাগ এবং সিমে গর্ত হওয়া এ রোগের লক্ষণ। এর আক্রমণের ফলে কচি সিমের আকার ছোট হয় বা কুঁকড়ে যায়। সাধারণত: আর্দ্র আবহাওয়া, ধূলা, বৃষ্টি এবং চলমান কোন বস্তু দ্বারা এই রোগ ছড়ায়।
পাতার দাগ পড়া রোগ : প্রথমে পাতায় খুব ছোট ধূসর বাদামী দাগ দেখা যায়। পরে দাগগুলো বড় হয় ও সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় ও হলুদ আকার ধারণ করে এবং পাতা ঝরে যায়।
হলুদ মোজাইক ভাইরাস : আক্রান্ত গাছের পাতায় হলুদ ও সবুজ রঙয়ের ছোট ছোট দাগ দেখা যায়। হলুদ অংশ ধীরে ধীরে বড় হয়ে সমস্ত পাতা হলুদ হয়ে যায়। রোগের আক্রমণ বেশি হলে গাছের ফলন কমে যায়। সাদা মাছি পোকা দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। গাছ ছোট আকারের হয় এবং বিবর্ণ হয়ে যায়।
ধূসর বাদামী কান্ড পচা রোগ : ছত্রাকজনিত এই রোগের আক্রমণের ফলে গাছের কান্ড ফেটে যায় এবং দ্রুত অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছ মারা যায়। এছাড়া শেকড়ে পচন ধরে, ফলে গাছ শুকিয়ে মারা যায়। বীজের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
পাউডারি মিলডিউ : ছত্রাক দ্বারা এই রোগ হয়। এই রোগ গাছের প্রায় সকল অংশে আক্রমণ করে। প্রথমে গাছের পাতায় সাদা পাউডারের মতো দেখা যায় এবং পরে গাছের কান্ডে ও সবুজ গুটিতে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে আক্রান্ত পাতা এবং শুঁটি ঝড়ে পড়ে। সাধারণত: মৌসুমের শেষের দিকে এই রোগ দেখা যায়।
সিমের মরিচা রোগ : এ রোগের ফলে সিমের গায়ে কালো রঙয়ের গোলাকার গর্তের সৃষ্টি হয় এবং কিনার ভালোভাবে বোঝা যায়।
প্রতিকার
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময় পরিচর্যা
১. চারা গজালে প্রতি মাদায় ১-২টি সবল চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হবে।
২. জমিতে আগাছা থাকলে পোকামাকড়, রোগজীবাণু ও ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। তাই জমিতে আগাছা জন্মালে তা তুলে ফেলতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) মাস পর্যন্ত সিম সংগ্রহ করা যায়।
উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ
প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি থেকে প্রায় ১৫০০-৩০০০ কেজি সিম পাওয়া যায়।
বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
সিম পেকে গেলে খোসা বাদামী রঙ ধারণ করে শিরাগুলো আরো স্পষ্ট হয়। আঙ্গুলে চাপ দিলে বীজ যদি শক্ত মনে হয় তখন ফসল সংগ্রহ করতে হবে। ভালো ও পুষ্ট গাছ বাছাই করে ফল ছিঁড়ে ভালোভাবে শুকাতে হবে। তাপরপর লাঠি দিয়ে ভালোভাবে পিটিয়ে বা হাত দিয়ে বীজ বের করতে হবে। বীজ যাতে ফেটে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বীজ ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে ঝাড়াই করে ১০% আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হবে।
সূত্র : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউ/ কৃপ্র/ এম ইসলাম