কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বোরো চাষের মৌসুমে বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সেচ সুবিধাবঞ্চিত ও লবনাক্ত এলাকার কৃষকদের মাঝে পানি ব্যবস্থাপনার নতুন পদ্ধতি ‘ইনার ক্যানেল সিষ্টেম’ নতুন আশা জাগিয়েছে। বোরো মৌসুমে এইসব অঞ্চলে চিংড়ি ঘের সমৃদ্ধ এলাকায় পানি ব্যবস্থাপনার এই নুতন পদ্ধতি প্রয়োগ করে সেচের সংকট মোকাবেলা ও লবণাক্ততার বিষাক্ত ছোবল থেকে নিরাপদে চাষাবাদ সম্ভব হয়েছে।
আশির দশক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপকভাবে লবণপানির বাগদা চিংড়ির চাষ আর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে উপকুলীয় অঞ্চলের নদ-নদী ও ভুগর্ভস্থ পানিতে লবনাক্ততার মাত্রা বেড়ে যায়। নদী ভরাট ও দখলের কারনে সেচের উৎস বন্ধ হওয়ায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোরসহ উপকুলীয় অঞ্চলের প্রায় অর্ধ কোটি কৃষক জমিতে সেচ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে।
এতে প্রতি বছর উপকুলীয় এলাকার পাঁচ লক্ষাধিক হেক্টর জমি অনাবাদী থেকে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি নিরসনেই উপকুলীয় কৃষক পেয়েছে নতুন পদ্ধতি ‘ইনার ক্যানেল সিষ্টেম’।
এ পদ্ধতিতে আবাদের ফলে এলাকার কৃষকদের পানি ও সেচ নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। এ ছাড়া লবণ-পানির এলাকায়ও চিংড়ি ঘেরে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ভালো ফল পেয়েছেন বলে একাধিক কৃষক জানান। পানিব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতিকে আরো সম্প্রসারণ ও প্রচারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘেরসমৃদ্ধ লবণ-পানি এলাকার সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগদা চিংড়ি ঘের তৈরির সময় জমির চারদিকে বাঁধ দেওয়া হয়। এ বাঁধের পাশ দিয়ে জমির পরিমাণ অনুযায়ী ৬ থেকে ১২ ফুট চওড়া করে এবং ৫-৬ ফুট গভীর করে চারদিকে একটি ক্যানেল কাটা হয়। চিংড়ি চাষের শুরুতে ঘেরের মধ্যে লবণ-পানি ঢোকানো হয়। যে কারণে এসব ঘেরে কোনো ধানচাষ হয় না। ঘেরের ভেতরে চারদিকে ক্যানেল কাটার ফলে জমিতে পানি না থাকলেও ক্যানেলে সব সময় পানি থাকে। এ ক্যানেলটি সাধারণত ঘেরের পানি কমে যাওয়ার পর মাছ ধরার সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়।
বোরো মৌসুমের শুরুতে যখন ঘেরের পানি কমে যেতে থাকে, তখন আশপাশের নদী ও খাল থেকে পানি দিয়ে ভরিয়ে রাখা হয়। কারণ ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য প্রচুর লবণ-পানির প্রয়োজন হয়। এ লবণ-পানি কিছুদিন ঘেরের ক্যানেলে থাকলে লবণের অনেকটা মাটির সঙ্গে চলে যায়। ফলে পানিতে লবণের মাত্রা কমে যায়। এরপর সেই পানি ধানের জমিতে দিলে কোনো ক্ষতি হয় না। এ ছাড়া পানিতে লবণের মাত্রা একটু বেশি থাকলেও জমিতে দেওয়ার পর তা ধানের জমিতে সংরক্ষিত না হয়ে আবারও পাশের ক্যানেলে চলে আসে। ফলে ধানের কোনো ক্ষতি হয় না। অনেকে আবার নদী ও খালে লবণ-পানি আসার আগেই পানি ঘেরের ক্যানেলে ধরে রাখে। পরে যখন প্রয়োজন হয় তখন ধানচাষে ব্যবহার করে থাকে। আবার কেউ কেউ ঘেরের চারদিকের ক্যানেলকে চার ভাগে ভাগ করে প্রথমে একটি অংশে লবণ-পানি ঢুকিয়ে পর্যায় সারণির মতো ক্রমান্বয়ে পানি অন্য ক্যানেলে স্থানান্তর করে পানিকে লবণমুক্ত করে ব্যবহার করছে। মূলত ঘেরের অভ্যন্তরীণ ক্যানেলকে কৃষকরা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে বোরো মৌসুমে পানির লবণাক্ততা থেকে নিজেদের জমির ধান রক্ষা করছে। পানিব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতিকে স্থানীয় কৃষক ও চিংড়ি চাষিরা নাম দিয়েছে ইনার ক্যানেল সিস্টেম, যা এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের কাছে খুবই প্রিয়।
খুলনা চাষিরা বলেন, এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে পানি খরচ বেঁচে যায়। ধান চাষে খরচ কম হয়। ফসলও ভালো হয়। অনেকে ১৪ কাঠা জমিতে ২৫মন ধানে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন । কৃষি বিভাগ বলছে, এই পদ্ধতি সম্প্রসারণ করা গেলে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর যেমন রক্ষা হবে তেমনি আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হবে উপকুলীয় অঞ্চলের অনাবাদী জমি।
খুলনা উপজেলঅ কৃষি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, এখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন করে বোরো মৌসুমের সময় বোরো আবাদ বৃদ্ধি করা হয়। এতে করে পানির খরচ কমে যাবে এবং ধানের আবাদও ভালো থাকে।
কৃষি বিভাগের হিসেবে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও যশোরসহ উপকুলীয় আট জেলায় আবাদী জমির পরিমাণ প্রায় নয় লাখ হেক্টর। এরমধ্যে বোরো মৌসুমে মাত্র সাতে তিন লাখ হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়।
বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিনারুল হক জানান, তিনিও এ ধরনের একটি পানিব্যবস্থাপনা স্থানীয় মাঠপর্যায়ে গিয়ে দেখেছেন। এটা লবণ-পানি এলাকায় খুবই কার্যকর পদ্ধতি। এটাকে সরকারি উদ্যোগে আরো সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কৃপ্র/এম ইসলাম