কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক।।
কার্বাইড ও ইথোফেন হলো বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ফল পাকানোর কেমিক্যাল। নির্দিষ্ট মাত্রায় ফল পাকানোর কেমিক্যাল হিসেবেই তা সারাবিশ্বে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে কার্বাইড নিষিদ্ধের কারণ হলো, কমার্শিয়াল কার্বাইডে সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক ও ফসফিন অপদ্রব্য হিসেবে মিশ্রিত থাকে যা প্রয়োগকারী/ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।বিস্তারিত লিখেছেন- ড. মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, ড. মো. আরিফুল ইসলাম ও ড. আবুল হাসনাত সোলায়মান
কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের ক্ষতির পরিমাণ না জেনেই সম্প্রতি রাজধানীতে বিপুল পরিমাণ আম ধ্বংস করা হয়েছে। ফলের রাজা আম। আম খেতে পছন্দ করে না- এমন লোকের সংখ্যা খুব কমই পাওয়া যাবে। ইতিহাস, সংস্কৃতি অথবা স্বাদ-গুণ যা-ই থাকুক না কেন, গত কিছু বছর ধরে আম খাওয়া নিয়ে চলছে নানান বিভ্রান্ত্মি। আর তাই আমের ভালো গুণাগুণের সঙ্গে যোগ হয়েছে অপপ্রচারও।
অপপ্রচারের কারণে দেশের চাষিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত্ম হচ্ছে তেমনি আতঙ্কে কিনে আম খাওয়া ছেড়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভেজালবিরোধী নানা অভিযানের ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। নিয়মিত অভিযান ও গণমাধ্যমের সুবাধে কুচক্রী অনেকের মধ্যে সচেতনতা আসছে। যারা এখনও ভেজাল পণ্য বিক্রি এবং বাজারজাত করার চেষ্টা করছে নিয়মিত অভিযানে এসব অসাধু চক্রকে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে এবং এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে বলে রাখা ভালো যে, বাজারে অন্যান্য ভেজালবিরোধী অভিযানের চেয়ে ইথোফেন/কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানোর ব্যাপারটি একটু ভিন্ন। এক্ষেত্রে মনে হয় অপপ্রচারটিই বেশি হয়।
বছর কয়েক আগেও ফল খাওয়া নিয়ে মানুষের এত নেগেটিভ ধারণা ছিল না। গ্রাম তথা শহরের মানুষ সবাই মিলে দেশিয় ফল বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে আম-কাঁঠালের স্বাদ নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত। অর্থ-বিত্তশালী আমপাগল অনেক মানুষ বিদেশ থেকে দেশে আসত শুধু আমের স্বাদ গ্রহণের জন্য। তৃপ্তিভরে নিজে খেত আর পারা-পড়শি ও আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বিলাত।
জুন-জুলাই মাস এলে আমের রস দিয়ে নতুন ধানের তৈরি চিড়া-মুড়িকে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে তৃপ্তি করে খেত গ্রামবাংলার মানুষ। পাকা আমের মধুর রসের গন্ধে চারদিক ম-ম করত। কোথাও কোথাও আবার একে ঘিরে শুরম্ন হতো নানান উৎসব। কিন্তু আমে কেমিক্যাল তথা কীটনাশকের নানান ব্যবহার এবং অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত প্রচারের কারণে এসবে মনে হয় এখন কিছুটা হলেও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
কিছুদিন আগে ঢাকার কাওরান বাজার এবং যাত্রাবাড়ীতে অভিযান চালিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ধ্বংস করা হয় কয়েক হাজার মণ আম। মিডিয়ায় দেখলাম তাদের অভিযোগ, আমগুলো ছিল অপরিপক্ব এবং ইথোফেন ও কার্বাইড দিয়ে পাকানো। ঠিক একইভাবে, ২০১৪ সালের জুন মাসে ঢাকার গাবতলীতে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে কয়েকশ’ টন আমও অন্যান্য ফল ধ্বংস করা হয়েছিল এবং দেখা গিয়েছিল যে, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হয়েছিল তা বাতাসে ফরমালডিহাইড মাপার যন্ত্র। পরে তিনটি সংস্থার পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে হাইকোর্ট সেই যন্ত্রটিকে অকার্যকর ঘোষণা দেয়; কিন্তু এর আগেই যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়েই গেছে। এবারের বুলডোজার দিয়ে আম ধ্বংস করার ঘটনাটি কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায়নি আমগুলো। যেখানে আমাদের দেশের এখনও এক-তৃতীয়াংশ লোক অপুষ্টিতে ভোগে সেখানে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কয়েক হাজার মণ আম ধ্বংস করা কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে আমাদের আরও বেশি ভাবতে হবে।
কার্বাইড ও ইথোফেন হলো বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ফল পাকানোর কেমিক্যাল, নির্দিষ্ট মাত্রায় ফল পাকানোর কেমিক্যাল হিসেবেই তা সারাবিশ্বে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে কার্বাইড নিষিদ্ধের কারণ হলো, কমার্শিয়াল কার্বাইডে সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক ও ফসফিন অপদ্রব্য হিসেবে মিশ্রিত থাকে যা প্রয়োগকারী/ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটা কম সময়ের মধ্যেই (২৪ ঘণ্টা) নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে।
মজার ব্যাপার হলো, ইথোফেন এবং কার্বাইডকে তাৎক্ষণিকভাবে মাপার জন্য কোনো যন্ত্রও আমাদের দেশে নেই। আর ইথোফেন কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদ কিছুটা তারতম্য মনে হলেও এর পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। তাহলে কোন ক্ষতির প্রভাবের কারণে আমাদের সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেট আমগুলো ধ্বংস করলেন সেটা এখনো পরিষ্কার নয়?
আর ফরমালিন, ফল ও শাকসবজিতে কাজ করে না। এটা শুধু আমিষে কাজ করে। ফরমালিন মুক্ত আমের যেসব ব্যানার দেখা যায়, তা অত্যন্ত্ম হাস্যকর। আমে প্রাকৃতিকভাবেই ফরমালিন থাকে। আম পাকানোর জন্য ফরমালিন কোনোভাবেই দায়ী নয়। অধিকাংশ সময় আমরা না বুঝেই ভ্রান্ত্ম ধারণা থেকে বলে থাকি যে, বাজারের সব আমই ফরমালিন মিশ্রিত, আর তাই এগুলো খাওয়া যাবে না। আমাদের এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে কোনো ফল ক্ষতিকর কি-না, তা বলা যাবে না।
প্রশ্ন হতে পারে খাবারে বিভিন্ন ধরনের আর্টিফিসিয়াল কেমিক্যাল নির্ণয়ের জন্য বাংলাদেশে কোনো ল্যাব আছে কি-না। এর উত্তর হলো বাংলাদেশে এখন বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক ল্যাব রয়েছে যেখানে কীটনাশকের মাত্রা পরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। যেমন- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফুড সেফটি ল্যাব, কৃষি গবেষণার কীটতত্ত্ব বিভাগের টক্সিকলজি ল্যাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ল্যাব ইত্যাদি।
অপরিপক্ব আম বাজারে আসুক এবং ভোক্তারা অধিক দামে কিনে খাক- সেটা আমাদের ভাষ্য নয়। আমরা শুধু এটুকু বলতে চাই যে, ঠুনকো অজুহাতে যেন হাজার হাজার টন ফল আর ধ্বংস করা না হয়। কোনো বিষয়কে পরিপূর্ণ ধ্বংস করার আগে যেন এর ক্ষতিকর এবং উপকারের মাত্রা হিসাব নিকাশ করে ধ্বংস করা হয়।
মনে রাখতে হবে যে, সামান্য পরিমাণে যদি কেমিক্যাল থেকেও থাকে, এর কারণে আমে যে উচ্চ মানের ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান আছে, তা নষ্ট হয় না। আর ঋঅঙ-এর মতে, প্রতিদিন আমাদের ফল খাওয়া দরকার ৪০০ গ্রাম সেখানে আমরা খাই মাত্র ২৪৮ গ্রাম। যেখানে আমরা এমনিতেই কম পরিমাণে খাই সেখানে কেমিক্যালের ভয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিলে-এর ঘাটতি কি অন্য কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব?
এসব বিষয়ে আমাদের ভোক্তা সাধারণসহ সংশিস্নষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আমরা যদি পরিপূর্ণ স্বাদ ও পুষ্টি উপাদান পেতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের আম পরিপক্বের নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত্ম অপেক্ষা করতে হবে। তাই সবশেষে বলতে চাই, দেশি ফল-আম নিয়ে কোনো অপপ্রচারের আগে যাচাই-বাছাই করে দেখুন, খারাপ অথবা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিছু না পেলে অবশ্যই অপপ্রচার থেকে বিরত থাকুন।
তথ্যসুত্র, যায়যায় দিন, লেখকবৃন্দ:শিক্ষক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা / কৃপ্র/এম ইসলাম