ড. মো. সহিদুজ্জামান: বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ একই দিনে নির্ধারিত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। বিগত ১৯ জুলাই, ২০১৬ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ এর তথ্য অনুযায়ী আগামী ২৩ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ১৮ নভেম্বর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁও এর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। পরদিন ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এর ভর্তি পরীক্ষা। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ২রা নভেম্বর। এছাড়া কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পরপর থাকায় অধিক দুরত্বের কারনে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়সুচি অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, একজন শিক্ষার্থীকে ৪ নভেম্বর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে পরদিন চট্রগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) পরীক্ষা দিতে হলে প্রায় ৪৬৬ কিমি বা প্রায় ১২ ঘন্টা ভ্রমন করতে হবে। অনুরূপভাবে ২৮ অক্টোবর খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহনকারী একজন শিক্ষার্থী পরদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) অংশগ্রহন করতে চাইলে তাকে ৩৮৫ কিমি বা প্রায় ৯ ঘন্টা ভ্রমন করতে হবে। বিশ্লেষনে দেখা গেছে, ঢাকায় অবস্থিত বিজ্ঞানের একটি শিক্ষার্থীর সময় বা দুরত্ব বিবেচনা করে প্রায় ১০টিঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করা অনেকটাই অসম্ভব হবে। বিশ্লেষন অনুযায়ী সকল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহনে ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থীকে শুধু অক্টোবরের ২২-২৯ তারিখ মোট ৫ দিনে গড়ে প্রায় ২২৯ কিমি রাস্তা ভ্রমন বা প্রায় ৫.৪ ঘন্টা ব্যয় করতে হবে। নভেম্বর মাসে ৯ দিনে মোট ২১১২ কিমি বা ৫৬ ঘন্টা (গড়ে ২৩৫ কিমি বা ৬.২ ঘন্টা) ভ্রমন করতে হবে। ডিসেম্বর মাসে গড়ে ২৪৬ কিমি বা ৬.৭১ ঘন্টা ব্যায় করতে হবে। তবে ভর্তি পরীক্ষার মাঝে বাড়ী ফেরা সহ মোট প্রায় ৭৭৮১ কিমি বা ১৯৪.৫ ঘন্টা (গড়ে প্রায় ৩৭০ কিমি বা প্রায় ৯ ঘন্টা) ভ্রমন করতে হবে।
বাস ভাড়া প্রতি কিমি ১.৪২ টাকা হারে ৭৭৮১ কিমি এর ভাড়া দ্বাড়ায় প্রায় ১১০৫০ টাকা এবং একজন শিক্ষার্থী যদি সবোচ্চ ২১ টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয় তাহলে খাওয়া ও থাকাসহ কমপক্ষে আরও প্রায় ৪২ হাজার টাকা খরচ হবে। এই গাণিতিক হিসেবের পাশাপাশি আনুসাঙ্গিক কিছু খরচ যেমন রিক্সা বা অটো ভাড়া সহ সর্বমোট খরচ হতে পারে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছু একজন শিক্ষার্থীকে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম এর মূল্য ও বিষয়ভিত্তিক ভর্তি ফি এর মধ্যে অসামজ্ঞস্য অভিভাবকদের আরও বিপাকে ফেলে দিয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু রয়েছে তাতে দেখা যায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদেরকে ছুটতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক জেলা থেকে আরেক জেলায়, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে, এমনকি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। অনেক সময় কোন শিক্ষার্থী এই জঠিলতা বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে যখন পছন্দের বিষয়টিতে ভর্তি হতে না পারে তখন হতাশা আর না পওয়ার বেদনা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত বিষয়ে ভর্তি হয়ে উদদীপনা হারিয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার যোগ্যতা সাপেক্ষ্যে সকল ভর্তি পরীক্ষার অংশগ্রহনের সুযোগ দানের মাধ্যমে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে বঞ্চিত হবে মেধাবীরা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি।
কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে (চীন, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল)। যদিও বিষয়টি নিয়ে আমাদের অনেক কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন আছে তবে দেশের যোগাযোগ, অধিক শিক্ষার্থী ও র্আ্থসামাজিক দিকগুলো বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনভাবে পরীক্ষা নেওয়ার অধিকার আছে। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তির বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি অতিদ্রুত চালু করতে না পারলেও অন্তত:পক্ষে দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকরা সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় রুটিন এমনভাবে করতে পারেন যাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ভোগান্তির শিকার না হন এবং একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতা অনুযায়ী তার পছন্দের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সকল বিষয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুরত্ব বিবেচনা করে কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পাশাপাশি করা যেতে পারে এবং বেশী দুরত্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে ক্যাডার ও ননক্যাডার চাকরির পরীক্ষা, মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রীভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে একযোগে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিষয়ভিত্তিক গ্রুপে ভাগ করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, একইভাবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা সম্পাদন করা যেতে পারে। মানবিক ও বানিজ্য শাখার বিষয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাও একইভাবে করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম এর মূল্য ও বিষয়ভিত্তিক ভর্তি ফি এর মধ্যে সামজ্ঞস্য নিয়ে আসা উচিত। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুুরীকমিশন তথা সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের সবোর্চ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এখানে সমাজের আলোকিত মানুষেরা জ্ঞান বিতরণ করে। তাদের বুদ্ধি, বিবেক ও বিচক্ষনতার কাছে এসব শিক্ষাথী ও অভিভাবক ভর্তি পরীক্ষায় ভোগান্তি ও জঠিলতা কাটিয়ে অতি দ্রুত সহজ ও অধিকতর কার্যকন সমাধান আশা করে।
লেখক: ড. মো. সহিদুজ্জামান
প্রফেসর, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২।
কৃপ্র/ এম ইসলাম