‘বিনা সেচে ধান : ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয়’
এসএম মুকুলঃ কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সমৃদ্ধির অন্যতম উৎস ধান। দেশে স্বাধীনতা-উত্তর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে উৎপাদন স্বল্পতার কারণে বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি করে রেশন হিসেবে দেয়া হতো। স্বাধীনতা পরবর্তী এ দেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে সাত কোটি। বাংলাদেশে বর্তমান জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি। পাকিস্তান আমলে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হতো, এখনো সেই একই পরিমাণ ধান উৎপাদিত হলে, এই দ্বিগুণের অধিক জনসংখ্যার অবস্থাটা কী হতো ভাবা যায়! ১৯৭০ সালে দেশে চাল উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় এক কোটি টনের মতো।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার সফলতার কারণে নতুন নতুন উন্নত জাতের ধান উদ্ভাবনের হওয়ার ফলে এখন প্রায় চার কোটি টন ধান উৎপাদন সম্ভাবনার পথে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিভিন্ন ঘাতসহিষ্ণু ধান উদ্ভাবন হওয়ায় ধান চাষের এরিয়া বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন হেক্টর। বর্তমানে দেশে যেসব ধান উৎপাদিত হচ্ছে তার ৮০ ভাগ ধানই উফশী জাতের। ফসলের আগাছা নির্মূল, ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়ার কাজ, বীজ বপন, সার ও কীটনাশক ছিটানো প্রভৃতি কাজের জন্য ব্রির খামার যান্ত্রিকীকরণ বিভাগের নেতৃত্বে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে যা সরকার নির্ধারিত ভর্তুকিতে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো_ বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে উঠে এসেছে।
উৎপাদন নতুন বিপ্লব
একথা অনস্বীকার্য যে, কৃষিক্ষেত্রের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব পদক্ষেপ, কৃষকদের অক্লান্ত শ্রম, বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা, উদ্ভাবিত নতুন জাত আবাদে মাঠ পর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রম। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে চার দশকের ব্যবধানে বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক, আবাদি জমি অনেক কমার পরও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ।
স্বল্প পরিসরে চাল রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ব্রি, বিনা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেশের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে উদ্ভাবিত শতাধিক নতুন জাতের ধান অঞ্চলভিত্তিক চাষাবাদে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) আশাবাদ অচিরেই চার কোটি টন ছেড়ে যাবে ধান উৎপাদন। ব্রি এ পর্যন্ত চারটি হাইব্রিডসহ ৮২টি উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। উন্নত জাতের ধানের মধ্যে আট থেকে নয় টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে এমন জাত রয়েছে পাঁচটি জাত। আটটি জাতের উৎপাদন ক্ষমতা ছয় থেকে সাত টনের বেশি। হেক্টরপ্রতি পাঁচ টন উৎপাদন হয় ১২টি জাতের ধান।
উদ্ভাবনে সাফল্য আর সাফল্য
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রতিকূলতা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ১০টি লবণসহিষ্ণু, চারটি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, পাঁচটি খরাসহিষ্ণু এবং দুটি শীত সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে_ বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের চাষাবাদ হয় এবং এ থেকে আসে দেশের মোট ধান উৎপাদনের ৯১ শতাংশ। আশার খবরটি হলো_ বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল এবং কম সময়ে উৎপাদনশীল দস্তা বা জিঙ্কসমৃদ্ধ আমন ধানের নতুন জাত ব্রি-৬২ অবমুক্ত করা হয়েছে।
এই ধানের প্রতি কেজি চালে ১৯ মিলিগ্রাম দস্তা বা জিঙ্ক এবং নয় শতাংশ প্রোটিন থাকবে, যা পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করবে। ব্রি-৬২ ফলন দেবে ১০৫ দিনে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হবে চার দশমিক দুই মেট্রিক টন ধান। তাছাড়া ব্রি ধান৫১ ও ৫২ এবং বিনা-১১, ১২ হচ্ছে জলমগ্ন সহিষ্ণু ধানের জাত যেগুলো ১৫ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে থাকলেও টিকতে পারবে। প্রতি হেক্টরে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন উৎপাদন হবে। অনুরূপ ব্রি ধান-৩৩ ও বিনা-১৩ সুগন্ধি জাতের ধান ১৩৮ থেকে ১৪৫ দিনে ঘরে তোলা সম্ভব। ফলন হবে হেক্টরপ্রতি চার থেকে সোয়া চার টন। দেশের হাওর এলাকার এই জাতের ধান নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশাকরা হচ্ছে। আবার ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান৫৯ উফশী জাতের বৈশিষ্ট্যশীল এবং ১৫৩ দিনের মধ্যে ফলনশীল এই ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হবে সাড়ে সাত টন।
ব্রি ধান৬০ লবণাক্ততা সহনীয় ধান ১৫০ দিনের মধ্যে লবণাক্ততার মাত্রাভেদে হেক্টরপ্রতি ফলন হবে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে সাত টন পর্যন্ত। জানা গেছে, ভিয়েতনাম থেকে আমন মৌসুমের জন্য আরো পাঁচটি উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধানের বীজ আনা হয়েছে। মাত্র ৯০ থেকে ৯৫ দিনে এজাতের ধানগুলোর ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ব্রি ধান৫০ বা বাংলামতি সুগন্ধি ধান ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এলাকায় ব্রি-৩৩ ও ৩৯ জাতের ধান আবাদ করে মানুষের খাদ্য সংকট এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আগাম জাতের এ ধান কেটে একই জমিতে রবিশস্য করাও সম্ভব হচ্ছে। ব্রি ধান৪২ ও ৪৩ খরাসহিষ্ণু উফশী জাতের বোনা আউশ ধান বিশেষত খরা ও বৃষ্টিবহুল এলাকায় যেমন_ ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা এলাকায় ধান ছিটিয়ে এবং ডাবলিং পদ্ধতিতে বপন করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য হাই অ্যামাইলোজযুক্ত, রক্তশূন্যতা পূরণে সহায়ক অধিক আয়রন যুক্ত, ডায়রিয়া নিরোধে সহায়ক জিঙ্কযুক্ত এবং রাতকানা রোগ নিরোধে সহায়ক ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে দেশের বিজ্ঞানীরা।
বিনা সেচে ধান : ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয়
রংপুর অঞ্চলে সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান বিনা সেচে আবাদ হয়েছে। ফলে কৃষকদের প্রায় সোয়া ২০০ কোটি টাকা আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। বলা হচ্ছে, আবহাওয়া ধান চাষের অনুকূলে থাকায় এবার ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৬১৩ হেক্টর জমি মধ্যে মাত্র ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৪ হেক্টর জমিতে কৃষকরা সেচ দিয়ে আবাদ করেছেন। বাকি ৪ লাখ ৬৭ হাজার ১১৯ হেক্টর জমি ছিল সেচ আওতার বাইরে। কৃষি অফিসের তথ্য মতে, প্রতি হেক্টর জমিতে কৃষকদের সেচবাবদ খরচ পড়ে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো। সেচের আওতার বাইরে যেসব জমিতে আবাদ হয়েছে সেই জমিগুলোয় সেচ দিলে কৃষকদের বাড়তি ব্যয় হতো ২১০ কোটি টাকা। প্রকৃতি আমন ধানের পক্ষে থাকায় কৃষকদের ওই টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
উৎপাদিত হবে ৫০ লাখ টন বাড়তি ধান
কৃষিবিদদের মতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমিসহ উপকূল ও হাওর অঞ্চলের জলাবদ্ধ এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিণত করতে পারলে বছরে ৫০ লাখ টন বাড়তি খাদ্য শস্য উৎপাদন করা সম্ভব। দেশের বিস্তীর্ণ জলাবদ্ধ এলাকা চাষের আওতায় আনার পাশাপাশি জলমগ্নতা সহিষ্ণু আরো ভালো ধানের জাত উদ্ভাবন করা গেলে বছরে আরো ৫০ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। ক্যাসেডের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৯০ লাখ ৯৪ হাজার হেক্টর জমি আবাদযোগ্য থাকলেও চাষ হয় ৮২ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এই জমির মধ্যে এক ফসলি জমির পরিমাণ ১৮ লাখ ৫৫ হাজার, দুই ফসলি জমি ৪৪ লাখ ৪২ হাজার, তিন ফসলি জমি ১৮ লাখ ৭১ হাজার হেক্টর।
তিন ফসলের অধিক ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে চাষযোগ্য পতিত ৩ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর এবং চলতি পতিত চার লাখ সাত হেক্টর জমি চাষের আওতায় আসছে না। কৃষি বিভাগের মতে শুধু সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে এক ফসলি প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করা যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদন বাড়ানো লক্ষ্যে পরিত্যক্ত ও পতিত প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমি ফসল চাষের আওতায় আনা হয়েছে। উপকূলীয় ১৪ জেলার আবাদযোগ্য ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮১ হেক্টর চলতি পতিত জমি চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে।
দক্ষিণাঞ্চলে অনেক চরের জমি অনাবাদি পড়ে আছে। হাওরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল অনাবাদি পড়ে থাকে। পরিকল্পনা মাফিক এই জমিগুলো আবাদ করার উদ্যোগ নিয়ে এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগালে ধান উৎপাদনে বিশ্বকে নতুন পথের সন্ধান দেবে বাংলাদেশ।
লেখক : কৃষি বিশ্লেষক এবং উন্নয়ন গবেষক।